Sunday, May 19, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়শীতের ফসলে শ্রমের গন্ধ ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব

শীতের ফসলে শ্রমের গন্ধ ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব

আমাদের শীত রুক্ষ শীতে টলস্টয়ের প্রটাগনিস্টের মতো একাকী হেঁটে চলে না। আমাদের শীত জসিমউদ্দিনের শীত।

  • মৌমিতা আলম

মাঠ ভর্তি জোনাকি। সবুজ ডানা মেলে আকাশের দিকে চেয়ে। কচি সবুজ জোনাকির শরীর ঘিরে এক সর্ষে গন্ধ। লোকে যে কেন বলে, চোখে সর্ষে ফুল দেখবি! সর্ষে ফুল দেখে আকণ্ঠ প্রেমে ডুবে যেতে মন্দ লাগার কথা তো নয়। জোনাকি ভর্তি মাঠের পাশে ম্রিয়মাণ ভুট্টাখেত। রণপা নিয়ে কাকতাড়ুয়ার মাথায় ঝুঁটির মতো ঝুঁটি নিয়ে সে শীতের শিরশিরে হাওয়ায় দুলছে। লম্বা লম্বা বারোমাসি বেগুন মাটি ছুঁয়ে অপেক্ষায় কৃষক গৃহিণীর। গোটা পৃথিবীর আব্রু ঢেকে শীতের কুয়াশা বিধবা পিসির থানের মতো ঠিক সাদা নয়, আকাশের থম মেরে থাকা মেঘের সঙ্গে মিশে এক কালচে শুভ্রতা নিয়ে ঢেকে রাখে পারাপার।

উত্তরবঙ্গের শীত শুধুই ঠান্ডা আর কুয়াশা নয়। শীত আসে ডালি ভর্তি সবুজ শাক আর নানা রকম সবজির পসরা সাজিয়ে। আমাদের শীত গাঢ়, প্রগাঢ় রুক্ষ শীতে টলস্টয়ের প্রটাগনিস্টের মতো একাকী হেঁটে চলে না।

আমাদের শীত জসিমউদ্দিনের শীত। যে শীত রাখাল ছেলেকে আহ্বান জানায় খেলার জন্য : ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।/আমার সাথে করতো খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,/সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।/ চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,/বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা।’

আমাদের শীত পাশাপাশি, জবুথবু হয়ে বসে একে ওপরের গায়ের ওম মেখে বাঁশ গাছের মুড়ো, ধানের খড়, পাটকাঠি জ্বালিয়ে দিন শেষে এক গল্প দাদু, বাবা, সন্তান, নাতি…প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলার সলতে। যে সলতে জ্বালিয়ে রাখে শীতে আগুন তাপতে পাশাপাশি বসা মুখগুলো। ধানের তুষ যেমন জ্বালিয়ে রাখে ধিকধিক আগুন। তেমনই শীত আর শীতের আগুন বাঁচিয়ে রাখা এই গল্পগুলো। উত্তরবঙ্গের শীত একাকিত্বের থেকেও বয়ে নিয়ে আসে পাশে থাকার, পরস্পরকে ছোঁয়ার স্বাভাবিক প্রগাঢ় ইচ্ছে।

কৃষকদের কাছে শীত কিছুটা লাভের নিশ্চয়তা। শরতের শেষে বা প্রথম বসন্তের ধান থাকে সঞ্চয়ে। ভাতের নিশ্চয়তা নিয়ে কৃষক এই সময় রবিশস্যের দিকে হাত বাড়ায়। সর্ষে, গম, ভুট্টা, করলা, শসা, বিনস, সিম, লাফা, পালং, বাবরি, ধনে পাতা আর উত্তরবঙ্গের সাদা সোনা ‘আলুর’ চাষ হয় শীতকালেই।

সাতসকালে ট্রেনের হুইসল শুনে রাতের পড়ে থাকা ছাইয়ের পাশে শুয়ে থাকা ভুলু একটু গা নাড়া দিয়ে না উঠলেও কৃষক থাকেন মাঠে। আলুর ধসা রোগের ওষুধ স্প্রে করতে নয়তো গই টানতে। পুরো শীত আলুর খুব যত্ন প্রয়োজন। করলার লকলকে ডালগুলোর নীচে খড় বিছিয়ে দেন কৃষক। মাটিতে হামাগুড়ি দেওয়া কুমড়োর ডালকে বাচ্চাদের হাঁটা শেখানোর মতন হাত ধরে ধরিয়ে দেয় মাচা। শীতকালে উত্তরবঙ্গের কৃষক শীতে কাঁপলেও উষ্ণতা বয়ে নিয়ে আসে বাজারের সবজি বেচে কিছু টাকার মুখ দেখার আশা। এবারের শীতের বাজারে শসা, লংকা বাদ দিলে বাকি সবজির দাম পাচ্ছেন কৃষকরা। মুখ বেজার করে বসে নেই দোকানদার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গত কয়েক বছরে বদলেছে শীতকালের মাঠের দৃশ্য। গম চাষের পরিবর্তে শুরু হয়েছে ভুট্টা চাষ। কয়েক বছর আগেও অচেনা ব্রকোলি এখন উত্তরবঙ্গের মাঠেও চাষ হচ্ছে।

তবে কি আর নেই শ্রেণিদ্বন্দ্ব যেমন কবি সুকান্ত বলেছিলেন : শীতের সকাল/দরিদ্রের বস্ত্রের আকাল/শীতের সকাল/অসাম্যের কাল/ধনীর সুখ আর আনন্দ/শ্রেণি সংগ্রাম এ নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব।

দরিদ্র আর ধনী ব্যক্তির ফারাক আজও বোঝে শীতকাল। গোটা পৃথিবী যখন লেপ, হিটার আর উষ্ণতার ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে কাদা, কৃষক তখন কষ্ট করে মাঠে শ্রম দিতে ব্যস্ত। শ্রম দিয়েও যে ফল আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। কোনও সরকারি গাইডলাইন ছাড়া কৃষক আজও পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা জ্ঞান পুঁজি করে সার থেকে ফসলের যত্ন নেয়। সেই সুযোগ নেয় বিভিন্ন সারের কোম্পানি। ভিটামিন দিলে আলু মোটা হবে, এই সার দিলে ধসা রোগ হবে না- এই বলে বলে কৃষকদের কাছে দামি সার, ওষুধ বিক্রি করে এজেন্টরা। বেচারা কৃষক সেই ফাঁদে পা দিয়ে বাধ্য হয়ে লোন নেন বেসরকারি মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানিতে, চড়া সুদে। উৎপাদন ও প্রয়োজনের ভারসাম্য বজায় রাখতে দরকার কৃষিক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তনের জন্য সরকারি উদ্যোগ। কিন্তু সরকারি কোনও সেরকম উদ্যোগ বাস্তবের জমিতে দেখতেই পাওয়া যায় না। তাই শীতের আলু যখন বসন্তে উঠবে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষক দাম পায় না। আলু বাদে অন্য ফসল যেমন টমেটো, শসা এসব বাইরে পাঠানো বা সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না, নেই এসব ফসল সংরক্ষণের জন্য বেশি হিমঘর।

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগেও শীতের ফসল বলতে টমেটো, করলা, শসা, সিম এসব বুঝত শুধু। শীতের সকালে দাম না পেয়ে হাটে টমেটো, করলা ফেলে দিয়ে আসা ছিল অতি পরিচিত দৃশ্য। একটু লাভের আশায় বিগত কয়েক বছরে কৃষক আলুর চাষে হাত বাড়ায়। কিন্তু হিমঘরে বন্ড পেতে অসুবিধে ও প্রয়োজনের থেকে বেশি উৎপাদন, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বারবার কৃষক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিকল্প কৃষির রূপরেখা তৈরির জন্য সরকারি কর্মশালার উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

কৃষকরা নিজেরাই বেছে নেন সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। তাই গত তিন বছরে কমেছে অন্য ফসলের চাষাবাদ। লাভের জন্য লোন নিয়েও উর্বর জমিতে চা চাষ করছেন কৃষকরা। কিন্তু সেখানেও নেই লাভের নিশ্চয়তা। দাম কমেছে চা পাতার। লকডাউনে ৪০-৪৩ টাকা/কেজি বিক্রি হওয়া পাতার দাম এখন ২০-২৫/ কেজি।

তিস্তা নদীর বাঁ দিকের অংশ ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের কাছে শীতের কয়েকমাস অর্ধাহার আর অনাহারের ঋতু। বড় বাগানগুলোতে কিছু স্থায়ী শ্রমিক থাকলেও, বেশিরভাগ বাগানে শ্রমিকরা ‘বিঘা কাজ’ (ঠিকাভিত্তিক) করেন। ডিসেম্বরের চা বাগান সবুজ মখমল গালিচা নয়। ডিসেম্বরের চা বাগান হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার। ডিসেম্বরে পাতা ঝুরে দেওয়া হয় আর নতুন পাতা আবার তোলা শুরু হয় আবার এপ্রিলে। এই চার মাস কর্মহীন চুক্তিতে কাজ করেন এই চা শ্রমিকরা। এই চার মাস চা বাগানগুলো চা শ্রমিক ফুল্লি ওরাওঁয়ের মতো অপুষ্টিতে ভোগা বুকের পাঁজর। তাঁর মিনমিন শ্বাসে ক্ষুধার গন্ধ। যে গন্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকে পৌঁছায় না। উত্তরবঙ্গের চার জেলায় দ্রুত বাড়তে থাকা ক্ষুদ্র চা চাষিদের বাগানে একজন চা শ্রমিকের মজুরি ১৫০-১৬০ টাকা। যদিও সরকারের নির্ধারিত মজুরি ২৫০ টাকা। তাই শীতকালে আরামের চা কাপে উষ্ণতার আমেজ এলেও, চা শ্রমিকদের কাছে শীতকাল ক্ষুধার কাল।

কোচা ভর্তি শাক-এর বাড়ির লাউ শাক, ওর বাড়ির লাফা নিয়ে বাড়ি পৌঁছায় বেগম বিবি। পাতে গরম লাফা/নাফা শাক আর আলুর ভর্তা। সাটি/ টাকি মাছের ভর্তা নেই। দেশি মাছ হারিয়ে গিয়েছে আলুর সারে। বহতা জীবন, প্রখর শ্রেণি বৈষম্যের উপস্থিতি ভাতের পাতে, মাঠের ফসলে। শীত তুমি আজও ধনী লোকের। বারান্দার মিঠে রোদে ইজি চেয়ারে বসে বাবু। ফুল্লি ওরাওঁ কাজ খোঁজে, টিকে থাকতে হবে চা পাতা ঝরার এই চার মাসে…।

(লেখক ময়নাগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক ও সাহিত্যিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL | ধোনির চেন্নাইকে হারিয়ে আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে শেষ চারে বেঙ্গালুরু

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আইপিএলের চতুর্থ দল হিসাবে প্লে অফে উঠল বেঙ্গালুরু। বেঙ্গালুরু বনাম চেন্নাইয়ের  গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে টসে জিতে বল করার সিদ্ধান্ত নেন...

Siliguri | তিস্তায় জলস্তর বেড়ে আটক ২, উদ্ধারে শুরু তৎপরতা

0
শিলিগুড়ি: পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির জেরে তিস্তার জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তি ঘটলো রংপোতে। নদীতে আটকে পড়লেন দু'জন। তবে তাঁরা স্থানীয় না পর্যটক তা স্পষ্ট...

Patiram | ঘুমের মধ্যেই বেহুঁশ করে চুরি, যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেলো চোরের দল

0
পতিরাম: এ যেন ফিল্মি কায়দায় চুরি। পরিবারকে গ্যাস স্প্রে করে অচৈতন্য করে বাড়ির সর্বস্ব চুরি করল চোরের দল। যাওয়ার আগে খেয়ে গেল আইসক্রিম। নগদ...

Bomb Recovered | বিস্ফোরণের পর ফের উদ্ধার জারভর্তি বোমা, নিষ্ক্রিয় করল বম্ব স্কোয়াড

0
কালিয়াচক: কালিয়াচকের রাজনগর মডেল গ্রামে বোমা বিস্ফোরণের পর আরও এক জার বোমা উদ্ধার (Bomb recovered) হল ঘটনাস্থল থেকে। ওই জার থেকে ৯টি প্লাস্টিকের বলবোমা...

Minority Scholarship Scam | স্কলারশিপের টাকা আত্মসাৎ! অভিযুক্ত ২ জনকে হেপাজতে চায় সিআইডি

0
বিশ্বজিৎ সরকার, করণদিঘি: মাইনোরিটি স্কলারশিপের (Minority Scholarship Scam) কোটি কোটি টাকা তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত মহম্মদ ফইজুল রহমান ও আবদুস সামাদকে নিজেদের হেপাজতে নিতে চায়...

Most Popular