মৈনাক ভট্টাচার্য
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘কাকাতুয়া’ কবিতার ভেতর থেকে তুলে আনা দুটো মাত্র লাইন- ‘সময় চলিয়া যায়-/নদীর স্রোতের প্রায়’। স্কুল জীবনের বয়ে যাওয়া এই সময়ের নিয়মানুবর্তিতার পাঠ হাতড়ে বড় হয়নি, এমন মানুষ বিরল। চাকরি আর পরিবার জীবনের জাঁতাকলের ফাঁকে বয়ে যাওয়া এই সময় ফিরিয়ে, ফুরফুরে হয়ে বেঁচে থাকার রসদের খোঁজে এক সর্বজনীন নান্দনিকতায় সবাই সহমত।
স্কুলের হীরক কিংবা প্ল্যাটিনাম যেই জয়ন্তীই হোক। গুটিগুটি পায়ে তাই ভিড় জমায় ব্যারিস্টার বীরেন থেকে চরণ চাপরাশির সকলেই। কতদিন পর দেখা। স্কুলবেলার সেই ছোট্ট সরল মুখের সঙ্গে সামাজিক ব্যক্তিত্বের নানা ঘাতপ্রতিঘাত মেশানো বয়স্ক মুখটা মিলিয়ে নিতে একটু যা সময় লাগে। তারপর যেন সময়কলে চেপে সবাই মিলেমিশে স্মৃতি রোমন্থনের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ানো।
স্কুলের চিলেকোঠায় প্রথম বন্ধুত্বের সেই দস্তাবেজ। টিফিন কৌটো খুলে সবুজ জ্যামের প্রলেপে দু’ফালা ত্রিকোণ পাউরুটির বদলে অন্য কারও টিফিন কৌটো থেকে ফিরে পাওয়া তার মায়ের মাখন চিনির পুরে প্যঁাচানো তাওয়া রুটির বার্গার বা মেক্সিকান ব্যারিটো।
সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে স্থায়ী যোগাযোগ রক্ষা এখন বন্ধনের ইচ্ছেবাড়ি। সময় ফুরিয়েও তাই কোথাও কোথাও রাশ থেকে যায় এই পুনর্মিলনের। বন্ধুত্ব বেড়ে ওঠে ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে। তৈরি হয় ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ গ্রুপ। কোন প্রাক্তনী দলের যে ‘গাছকাকা’ মানুষটা, ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহরের পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে এতদিন এককভাবে গাছ লাগাতেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেই উদ্যোগকে আরও বিস্তারিত করে উত্তরবঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেয় বাকিরা। এমন অনেক ফলিত উদাহরণ এই শহরে কান পাতলেও শোনা যায়। চাকরি সূত্রে সন্তানসন্ততি বাইরে। স্কুল জীবনের বন্ধুদের পাশে থাকার আশ্বাসে ভর করে কাটিয়ে ওঠা যায় নিঃসঙ্গের বিষণ্ণতা। প্রাক্তনী পুনর্মিলনের নির্যাসে বাঞ্ছারাম হয়ে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠার গল্পও এখন নানা শহর, গ্রামে। এইসব পুনর্মিলন নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণাও তাই কম হচ্ছে না। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ডেটাবেসের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের আবরণ মানুষের সুখী হওয়ার প্রধান কারণগুলির একটি। মনের বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব বয়সিদেরই উজ্জ্বলতা পায় স্নেহ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সততার মতো বিষয়গুলি। অভ্যেস তৈরি করে পারস্পরিক বোঝাপড়ার।
প্রাক্তনী পুনর্মিলনে তাই, চোখের চালশে সরিয়ে সেই সময়ের মূল্যবোধের সঙ্গে আজকের দিনে নিজেকে আর একবার তুল্যমূল্যে মিলিয়ে নেওয়া যায়। বন্ধুদের মেলমেলাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কত বৈচিত্র্য।
এমনভাবেই হঠাৎ হঠাৎ হয়তো চোখের সামনে উঠে আসে হেরো কিছু বন্ধুর হিরো হয়ে ঘুরে দাঁড়াবার লড়াইয়ের গল্পও। পুনর্মিলন সেই রূপকথাদের ঠাকুরদার ঝুলিতে যত্ন করে তুলে রাখে। যদি উত্তরসূরিদের জীবন গড়ায় কাজে লাগে।
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং সাহিত্যিক)