- গৌতম সরকার
বাঘ ভাণ্ডার। কোচবিহার জেলার একটি গ্রাম। পুণ্ডিবাড়ি ও বাণেশ্বরের মাঝে। কোনও কালে গ্রামটিতে বাঘের ভাণ্ডার ছিল কি না, জানা নেই। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় অগ্রণী দেবব্রত চাকির কাছে কোনও তথ্য নেই। জানালেন, এ নিয়ে কোনও অনুসন্ধান হয়নি এখনও। তবে কোনও সময় গ্রামটিতে বাঘের আনাগোনা হয়ে থাকতে পারে। পাতলাখাওয়া জঙ্গল খুব দূরে নয়। যেখানে একসময় ক্যাম্প বানিয়ে শিকার করতেন কোচবিহারের মহারাজারা।
সে যাই হোক, কোচবিহার জেলা বাঘহীন। ভবিষ্যতেও ওই জেলায় বাঘের বসবাস একেবারেই কষ্টকল্পনা। এ জেলায় বাঘের আরেকটি পরিচয় আছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল কোচবিহার জেলা। আজকের ছন্নছাড়া দশা দেখে এখনকার প্রজন্ম সেই একচ্ছত্র আধিপত্য আঁচ করতেও পারবে না। বামফ্রন্টের মেজো শরিক। কিন্তু ওই জেলায় বড় শরিক হিসেবেই স্বীকৃতি ছিল। বামফ্রন্টের সমঝোতায় জেলার একমাত্র লোকসভা আসনটি ফরওয়ার্ড ব্লকের। ৯টি বিধানসভার ৫টিই তাদের জন্য বরাদ্দ।
সেই ফরওয়ার্ড ব্লকের নির্বাচনি প্রতীক সিংহ। যে কোনও কারণেই হোক, কোচবিহারের রাজবংশী জনতার মুখে সিংহটাই ছিল বাঘ।
কোচবিহারের রাজনৈতিক মানচিত্রে একসময় রাজ করেছে বাঘ। সেই বাঘ কোচবিহার থেকে খেদিয়ে দিয়েছে ঘাসফুল। ওই জেলায় এখন ঘাসফুল, পদ্মফুলের ভাগাভাগি। ‘বাঘ’ নিশ্চিহ্ন। পাশের জেলা আলিপুরদুয়ারে অতীতে বাঘের আবাস ছিল। বক্সা বনে ব্যাঘ্র প্রকল্প গড়ে উঠেছিল।
একসময় সেই বন বাঘশূন্য হয়ে যায়। এখন মাঝে মাঝে দু’-একটা ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এত বাঘের গল্প শোনানোর কারণ একটিই– দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাঘেরও মৌরসিপাট্টা যেমন স্থায়ী হয় না, মানুষেরও তাই। পৃথিবীর ইতিহাসে ভিটেমাটি থেকে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা কম নয়। নিজের ভিটেয় যাঁরা শের, উৎখাত হলে তাঁরাই ইঁদুর। নরেন্দ্র মোদি ভারতের রাজনীতিতে নিজেকে সেরা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। তাঁর সাধ, লোকসভা যেন বিরোধীশূন্য হয়। সংসদে সম্প্রতি সেই ইচ্ছা প্রকট করেছেন।
২০১১-র পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও একই ইচ্ছে হয়েছিল। জনমতের পরোয়া করা হয়নি তখন। অন্য দল ভাঙিয়ে, বিধায়ক-সাংসদের সংখ্যা বাড়িয়ে, একের পর এক পুরসভা, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের অভিযানে তাৎক্ষণিক সাফল্য কম আসেনি। তাতে রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস সংসদ, বিধানসভায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু গোকুলে বেড়েছে বিজেপি।
সদ্য একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছে যে, আগামী লোকসভা ভোটে তৃণমূল ২২টি আসন পেলে বিজেপির দখলে যেতে পারে ১৯টি। যাকে বলে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস। একেই বলে ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়…।’ ‘আমরা ২৩৫’ আস্ফালন করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এখন বিধানসভায় একা সিপিএম নয়, গোটা বামফ্রন্টটাই শূন্য। এখন তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছ বিজেপি। মোদি বা মমতা নিজেদের শের মনে করতে এতই মরিয়া যে, বাঘ রাজত্বের নিয়মটা মনে রাখেন না।
যতই শক্তিশালী হোক, একা একা জঙ্গলে বেঁচে থাকা বাঘের পক্ষেও কঠিন। বনে হরিণ থাকা চাই। অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা প্রয়োজন। সংসদীয় গণতন্ত্রও সেরকম। বিরোধীশূন্য করে দিলে শাসকের অস্তিত্ব সংকট অবধারিত। নরেন্দ্র মোদির শখ হয়েছে, ‘আব কি বার, ৪০০ পার।’ জীবদ্দশায় রেকর্ড গড়ার প্রয়াস। যে কারণে ছাইভস্ম যাই পাচ্ছেন, হাতে মেখে নিচ্ছেন। জনতার রায়ে বিশ্বাস নেই। তাই ভিন্ন কৌশল।
আসন সংখ্যার নিরিখে ক্রমশ প্রান্তিক হতে বসা নীতীশ কুমারকে ইতিমধ্যে কোলে বসিয়েছেন। জাঠ নেতা জয়ন্ত চৌধুরীকে অখিলেশ যাদবের শিবির থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অনেক এগিয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগে বিজেপি সহযোগী ওয়াইএসআর কংগ্রেস যাঁকে জেলে পুরেছিল দুর্নীতির অভিযোগে, সেই চন্দ্রবাবু নাইডু হঠাৎ ক্লিনচিট পেয়ে ধবধবে হয়ে উঠেছেন। কিছুদিন জেলে বাস করে আপনি বাঁচলে বাবার নাম নীতিতে অমিত শা, জগৎপ্রকাশ নাড্ডার সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি পৌঁছেছেন।
সত্য-মিথ্যার বিচার পরে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রকাশ্যে বলছেন, তাঁকে বিজেপিতে যোগ দিতে বলা হয়েছে। তার আগে বলেছেন, আপ ভাঙতে বিধায়ক পিছু ২৫ কোটির টোপ দেওয়া হয়েছে। ইডি’র সমনের পর সমনের কাঁটা তো ঝুলছেই কেজরিওয়ালের পিছনে। এ সব অপারেশনের গল্প বলায় ইডি আবার পিছন পিছন ঘুরছে সাক্ষী হিসেবে তাঁর বয়ান নেবে বলে। কেজরিকে হাত করতে পারলে দিল্লি, পঞ্জাবে আর বাধা থাকে না। শিবসেনাকে ভেঙে ইতিমধ্যে উদ্ধব ঠাকরেকে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ার শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
এনসিপিকে টুকরো করে শারদ পাওয়ারকে নির্বিষ করে চাপে ফেলার ব্যবস্থা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় বিরোধী জোটের দফারফা নিশ্চিত করে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশজুড়ে পদ্ম ফোটানোর এই অভিযান যে ইভিএমে জনমতের অপেক্ষা না করেই, তা স্পষ্ট সম্প্রতি চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের ‘কীর্তি’তে। যে ঘটনায় ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ শব্দবন্ধনীটি ব্যবহার করেছে সুপ্রিম কোর্ট। যেনতেনপ্রকারেণ সংসদ, বিধানসভাকে বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা বাস্তবে তাই। এতে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবর খোঁড়া হচ্ছে সন্দেহ নেই। তৈরি হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিভূমি।
ইতিহাস চাউসেস্কু, সাদ্দাম হোসেনদের দেখেছে। চাউসেস্কুর মূর্তি পর্যন্ত টেনে নামিয়েছে জনতা। দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান। যে যতই শের বনতে চান, আসল দড়িটা জনতা জনার্দনের হাতে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন আর গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়ক হোন, পুতুল নাচানোর সুতোটা একদিন না একদিন মানুষ কেড়ে নেয়। জঙ্গল বাঘশূন্য হয়ে যায়, একনায়ক তো কোন ছার।