- দেবাশিস দাশগুপ্ত
আসন বণ্টন নিয়ে বামফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে ঝামেলার মধ্যেই দিনদুয়েক আগে কথা হচ্ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের এক তরুণ নেতার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘সিপিএম ভেবেছেটা কী। ওরা যা বলবে, তাই আমাদের মেনে নিতে হবে? আমরা পুরুলিয়ার আসন ছাড়ব না। তাতে যা হওয়ার, তাই হবে। সেরকম হলে বামফ্রন্ট ভেঙে যাবে।’ আমি বললাম, তাহলে তো ফ্রন্ট ভাঙার দায় তোমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে। ওই উত্তেজিত তরুণ নেতা বললেন, ‘সে যখন ভাঙবে, তখন দেখা যাবে।’
বহুদিন পর বামফ্রন্টের শরিক দলের তরুণ তুর্কি নেতাকে সিপিএমের দাদাগিরির বিরুদ্ধে এভাবে গর্জে উঠতে দেখলাম। প্রায় আড়াই দশক হল, বামেরা রাজ্যের ক্ষমতায় নেই। পালাবদলের পর একের পর এক ভোটে বামেদের রক্তক্ষরণ হয়েছে। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর বামেদের মিছিল, মিটিংয়ে লোক হয়, ভিড় উপচে পড়ে। কিন্তু তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না ভোটের মেশিনে। ফলে তারা বঙ্গ রাজনীতিতে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। বামেদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে একটা বাইনারি তৈরি করা হচ্ছে। মিডিয়ার একাংশ দেখাতে চাইছে, বাংলায় এই দুই দল ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল নেই।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বামেরা বিজেপি এবং তৃণমূলের হাতে তামাক খাবে না, এমন দলকে পাশে নিয়ে নতুন পথের দিশা দেখাতে চাইছে। এমনটাই দাবি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর। কী সেই নতুন পথ? সিপিএম চাইছে কংগ্রেস, আইএসএফের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে আসন সমঝোতায় যেতে। বৃহত্তর স্বার্থে তারা তাই ফব, আরএসপি এবং সিপিআইকে তাদের ভাগ থেকে একটি করে আসন ছাড়তে অনুরোধ করেছে। সিপিএম নিজেরাও কয়েকটি আসনের দাবি ছেড়ে দেবে। গোল বেঁধেছে এখানেই। ফব এবং আরএসপি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, তারা আসন ছাড়বে না। সিপিআই অবশ্য তাদের পুরোনো আসন বসিরহাট ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে।
ফরওয়ার্ড ব্লকের তরুণ নেতাটি যে কথা বলেছিলেন, কিছুদিন আগে বামফ্রন্টের বৈঠকে সেই কথাই ফ্রন্ট চেয়ারম্যানের মুখের উপর শুনিয়ে দিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায়। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, এভাবে যদি শরিকদের আসন ছাড়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, তাহলে আর ফ্রন্ট রেখে লাভ কী। বামফ্রন্ট ভেঙে দিলেই হয়। ফব আরও চটেছে কোচবিহার এবং পুরুলিয়ায় কংগ্রেস প্রার্থী দিয়ে দেওয়ায়। এই দুই কেন্দ্রেই ফব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট। ফরওয়ার্ড ব্লক পুরোদমে প্রচারও শুরু করে দিয়েছে। বিমান নিজে কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বকে কোচবিহার কেন্দ্র থেকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। কিন্তু প্রবীণ বাম নেতার অনুরোধ কংগ্রেস রাখেনি। এরই মধ্যে কংগ্রেসের কোনও নেতা প্রকাশ্যেই বামেদের হয়ে প্রচারে না নামার জন্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। ফলে বিমানের নতুন পথে চলার দিকে পদে পদে বাধা আসছে। যদিও দুই পক্ষ এখনও সমঝোতা এবং যৌথ প্রচারের ব্যাপারে আশাবাদী।
বাম জমানায় মুর্শিদাবাদ জেলার কয়েকটি অংশে, কোচবিহার, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, জলপাইগুড়ির কিছু এলাকায় ফব’র ভালো শক্তি ছিল। মুর্শিদাবাদে আরএসপিরও শক্তপোক্ত সংগঠন ছিল একসময়। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চল, জয়নগরে আরএসপি খুব শক্তিশালী ছিল। আবার উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, মেদিনীপুরের কিছু অংশে দাপট ছিল সিপিআইয়ের। পালাবদলের পরে সব জেলাতেই বামেদের শক্তিক্ষয় হয়েছে। ভোটের হারও তলািনতে। সিপিএমের ভোট যদি ১০ শতাংশের মধ্যে থাকে, তবে আরএসপি, ফব, সিপিআইয়ের ভোট সেখানে এক শতাংশের বেশি নয়।
শরিক দলগুলির যা অবস্থা, তাতে তাদের রাজ্য দপ্তরগুলি খাঁখাঁ করে। ভোট আসছে বলে তবু পার্টি অফিসগুলোতে কিছু লোকজন আসেন। এমনি সময়ে লোকজনকে দেখাই যায় না। জেলায় জেলায়ও একই অবস্থা শরিক দলগুলির। পরিবর্তনের পর অনেক জেলায় সিপিএম সহ বামেদের সব শরিকের পার্টি অফিস গায়ের জোরে বন্ধ করে দিয়েছিল কিংবা দখল করে নেওয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য সেই পরিস্থিতি নেই। শাসকদল গোষ্ঠীকোন্দল সামাল দিতে পারছে না অনেক জেলায়। ঘাটালের তারকা প্রার্থী দেব এক সভায় বললেন, তৃণমূলকে হারাতে পারে একমাত্র তৃণমূলই। তবে এসব বেশিদিন থাকবে না। ভোট যত এগিয়ে আসবে, তত এসব পিছনে পড়ে যাবে। এটা যেমন সত্যি, তেমন নানা দুর্নীতির প্রশ্নে শাসকদল এখন অনেকটাই কোণঠাসা। এখন আর তারা বাম শরিকদের অফিস দখল করার অবস্থায় নেই। তা সত্ত্বেও বাম শরিকরা এই মুহূর্তে জেলায় পার্টি অফিস খোলার সাহস দেখাতে পারছে না। লোকই নেই অফিস খোলার মতো।
এই প্রেক্ষাপটে আরএসপি, ফবর মতো শরিকরা কীসের জোরে আসন নিয়ে জেদাজেদি করছে, বোঝা মুশকিল। যেখানে যেখানে তারা লড়াই করবে, সেখানে শরিকদের নির্ভর করতে হবে সিপিএমের উপরে। এটা বাস্তব সত্য। সেটা বুঝতে হবে শরিকদের। তা না বুঝে যদি এই আসন ছাড়ব না, ওই আসন কেন ছাড়ব, এরকম একগুঁয়েমি করে শরিকরা, সেটা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারার শামিল হবে। সিপিএমের অন্দরে তা নিয়ে কথা হচ্ছে। বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য তো শনিবার বলেই ফেলেছেন, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের কিছু শরিকের এমন অবস্থা যে, বহু জায়গায় হয়তো তাদের ঝান্ডা ধরার লোক নেই। বিকাশের এই মন্তব্যে শরিক নেতাদের গায়ে ফোসকা পড়তে পারে, তাঁরা গোসা করতে পারেন। কিন্তু এটাই রূঢ় বাস্তব।
আবারও বলছি, এটা বাস্তব। অলীক স্বপ্ন ছেড়ে বাস্তবের রাস্তায় হাঁটলে আখেরে তাদেরই লাভ। লোকসভায় শূন্য, বিধানসভায় শূন্য। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও বামেদের সেই শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। সিপিএমের তো তবু ঝান্ডা ধরার মতো কিছু লোক এখনও আছে। এবারের ভোট ফব, আরএসপি, সিপিআইয়ের মতো মেজো শরিকদের কাছেও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তারা যদি এক শতাংশ ভোটও বাড়াতে পারে, সেটাই হবে অনেক বড় ব্যাপার।
ফব’র নেতা নরেেনর সুরেই আরএসপির এক প্রবীণ নেতা বলছিলেন, ‘সিপিএম থাকুক কংগ্রেস, আইএসএফকে নিয়ে। তাদের আসন দিতে যখন আমাদের আসন ছিনিয়ে নিতে চায় সিপিএম, তখন আর বামফ্রন্ট থেকে লাভ কী?’ শরিকরা যতই লম্বা চওড়া ভাষণ দিক না কেন, কেউ বামফ্রন্ট ছেড়ে যাবে না। এটা সিপিএম নেতারাও ভালোই জানেন। অতীতে বামফ্রন্ট সরকারে থাকার সময় অনেক ইস্যুতে সিপিএমের সঙ্গে শরিকদের মতভেদ হয়েছে। তারা সরকার এবং ফ্রন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছে, নাটক করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও শরিকই সরকার ছাড়েনি, মন্ত্রিত্ব ছাড়েনি, বামফ্রন্ট ছাড়েনি। তখন ক্ষমতা একটা বড় ব্যাপার ছিল। এখন সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। শরিকরাও জানে, ফ্রন্ট ছাড়া গতি নেই। যেমন কানু ছাড়া গীত নাই।
কোচবিহারে যখন ফব এবং কংগ্রেসের মধ্যে আড়াআড়ি লড়াই হচ্ছে, ঠিক তখন মুর্শিদাবাদে সিপিএম এবং কংগ্রেসের কোলাকুলি চলছে। বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরী পাশের মুর্শিদাবাদে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের হয়ে প্রচারে নামছেন। সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীর সমর্থনে সক্রিয় ভূমিকায় নেমেছিল সিপিএম। দুই দলের নজরদারির ফলে এলাকায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভোটের সময় দাঁত, নখ বার করার সাহস দেখাতে পারেনি। সাগরদিঘিতে জিতেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী। শনিবারই উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের বেলেঘাটায় কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্যের সমর্থনে মিছিলে এবং সভায় যোগ দেন বিমান বসু এবং দলের কলকাতা জেলার নেতারা। ছিলেন বাম শরিক দলের নেতারাও। প্রশ্ন উঠছে, দিল্লি, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় কংগ্রেস, সিপিএমের এত মাখামাখি, আবার কোচবিহারে বাম শরিক ফব’র সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই। এতে অন্য বার্তা যাবে না তো? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।
(লেখক সাংবাদিক)