- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর আদর্শ নির্বাচনি বিধি চালু হয়ে গেলেও কেন্দ্র সরকারের গ্রামোন্নয়নমন্ত্রক একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ২০২৪-’২৫ অর্থ বছরে নতুন মজুরি ঘোষণা করেছে। যে কোনও স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এই বিষয়টি হতবাক করবে।
এতদিন সংবিধান স্বীকৃত যেসব বিধিনিষেধের কথা শুনে এসেছে পাঁচ পাবলিক, শুনে এসেছে এটা করা ঠিক ওটা করা অন্যায়। সেসব বিধিনিষেধকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে শাসক তার মর্জিমতো যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা অর্জন করেছে – এটা ভেবেই এখন মাথায় হাত পড়বে পাঁচ পাবলিকের। সেই ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকেই আমরা পাঁচ পাবলিক দেখে এবং শুনে এসেছি একটা কথা। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর আদর্শ নির্বাচনি বিধি চালু হয়ে গেলে, কোনও সরকারই কোনও নতুন প্রকল্প বা আর্থিক ঘোষণা করতে পারবে না। প্রথমাবধিই এই বিধিনিষেধটি আরোপ করেছে নির্বাচন কমিশন।
সেই থেকে এখনও পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধি, মোরারজি দেশাই, রাজীব গান্ধি, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিং অবধি কোনও প্রধানমন্ত্রীর আমলেই নির্বাচন কমিশনের এই বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস কোনও সরকারই দেখায়নি। এই প্রথম পাঁচ পাবলিক দেখল কেন্দ্রে এমন একটি সরকার এখন ক্ষমতায় রয়েছে যারা আইন বা সংবিধান কোনও কিছুরই পরোয়া করছে না। তারা মনে করছে, তাদের সব কাজকে আইনসিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়ার মতো মানুষ সব প্রতিষ্ঠানেরই শীর্ষে রয়েছে।
কেন্দ্রে যে দলটি এখন সরকার চালাচ্ছে তারা লাজলজ্জার মাথা খেয়ে যা ইচ্ছা তাই করতেই পারে। কারণ তাদের কাছে ভোটে জেতার দায়টা অনেক বড়। এমনিতেই বলে লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। এই তিনটিই তারা জয় করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের অনৈতিক কাজগুলি করার ছাড়পত্র তাদের দিচ্ছে কে? যারা দিচ্ছে তারা সম্ভবত শাসকদলের থেকেও দশগুণ বেশি অপরাধী।
আর ঠিক এখানেই কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কেন্দ্র সরকার বলছে নির্বাচন কমিশনের সম্মতি নিয়েই নির্বাচনি প্রক্রিয়া চালু হয়ে যাওয়ার পরও এই ঘোষণা তারা করেছে।
এবার একটু ভেবে দেখা যেতে পারে এদেশে নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পরই এই রকম একটি বিধিনিষেধ চালু হয়েছিল কেন। দেশের সংবিধান প্রণেতা এবং আইন প্রণেতারা সকলেই মনে করেছিলেন, এই বিধিনিষেধটি না থাকলে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে যে কোনও দল নতুন নতুন প্রকল্প এবং আর্থিক সুবিধা ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভোটারদের প্রলুব্ধ করতে পারে।
শাসকদলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ রুখতে এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখতেই এই বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল নির্বাচন কমিশন।
সেই নির্বাচন কমিশন এবার আদর্শ নির্বাচনি বিধি চালু হয়ে যাওয়ার পর, একশো দিনের কাজে দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির কেন্দ্রীয় সরকারি ঘোষণায় সিলমোহর লাগিয়ে দিল। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রক বলেছে, নির্বাচন কমিশনের সম্মতিক্রমেই এই ঘোষণা তারা করেছে। কোন যুক্তিতে নির্বাচন কমিশন এই ঘোষণায় সিলমোহর লাগিয়ে দিল তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তিই নির্বাচন কমিশন বা কেন্দ্র সরকার উপস্থিত করতে পারেনি। সবটাই ধোঁয়াশা রেখেছে দু’পক্ষই।
যে রাজ্যগুলিতে একশো দিনের কাজের মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে তার ভিতর আটটি রাজ্যই বিজেপি শাসিত অথবা বিজেপির জোট সরকার। চারটি রাজ্যে অ-বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই রাজ্যগুলিতে মজুরি বৃদ্ধির হারের তুলনামূলক বিচার না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না ভোটের সময় এই বৃদ্ধির প্রকৃত কারণটি খেটেখাওয়া মানুষের প্রতি সরকার বাহাদুরের সহানুভূতি অপেক্ষাও ভোটে জেতার তাগিদটি বেশি। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এই ঘোষণাটি ভোটের আগে করা গেল না কেন? ভোট যখন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের প্রক্রিয়াও যখন চলছে, তখনই সরকারের এই প্রেম উথলে উঠল কেন — তাহলে তারও কোনও উত্তর নির্বাচন কমিশন বা সরকার কারও কাছেই মিলবে না। কারণ এর কোনও উত্তর তাদের কাছে নেই।
সরকারের কথা বাদ দিন। ভোটের সময় এরকম একটি সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজের নিরপেক্ষতাকেও বড়সড়ো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল।
এমনিতেই এই নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে, এই নির্বাচন কমিশন শাসকদলের আজ্ঞাবহ। সেই অভিযোগ সবটাই যে মিথ্যা এমনও নয়। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সময় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ আমলাকে নিয়োগ করা হয়েছে এই পদে। এতদিনকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে কমিশনার বাছাইয়ের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সে জায়গায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও কেন্দ্রের একজন মন্ত্রীকে স্থান দেওয়া হয়েছে। পুরো বিষয়টিই এমনভাবে করা হয়েছে যেন এই কমিটিতে শাসকদলের বক্তব্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গৃহীত হয়। তাই হয়েছেও। শাসকদলের পছন্দের আমলাই বসেছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও অন্য দুজন এমন নির্বাচন কমিশনারকে বাছা হয়েছে যাঁরা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত এই কমিশন কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে – সে নিয়ে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ এবং সংশয় প্রথমাবধিই ছিল।
বিরোধী দল এর আগে অভিযোগ করেছিল, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতিত্ব দেখায়। সেই অভিযোগও যে খুব মিথ্যা তা বলা যাবে না। পাঁচ পাবলিক সাদা চোখেই দেখেছে ভোটের মুখে সারা দেশ ঘুরে প্রধানমন্ত্রী মোদির নানারকম রংদার প্রকল্প ঘোষণা শেষ হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। এ পর্যন্ত তা-ও ঠিক ছিল। অন্তত একটা চক্ষুলজ্জার ব্যাপার ছিল। কিন্তু আদর্শ নির্বাচনি আচরণবিধি চালু হওয়ার পরেও কেন্দ্র সরকারের এই মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশন যেভাবে সম্মতি দিল, তাতে বলতেই হচ্ছে নির্বাচন কমিশন নিজেই লাজলজ্জার মাথা খেয়েছে। এরপর বিভিন্ন বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির সরকার যদি ভোটের সময় এরকম সব সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনের সম্মতি চায়, কী করবে তখন নির্বাচন কমিশন? সেসব সিদ্ধান্তেও কি সম্মতি দেবে? তার চেয়েও বড় কথা, নির্বাচন কমিশন নিজেই কি বুঝিয়ে দিল না, স্বচ্ছ নির্বাচনের পরিবর্তে শাসকের স্বার্থ রক্ষাতেই তার আগ্রহ বেশি।
আমরা পাঁচ পাবলিক স্তম্ভিত হয়ে বসে বসে ভাবি। ভাবি, আইন রক্ষা করার দায়িত্ব যার ছিল, সে নিজেই যদি আইন ভাঙে তাহলে তাকে কি আর বিশ্বাস করা যায়? এই নির্বাচন কমিশন যে সত্যিই পক্ষপাতমুক্ত নির্বাচন করাবে – সে ভরসা কোথায়?