- গোপাল দে
পরাধীন ভারতবর্ষে বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে চর্চার জন্য ১৯১৪ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম সভাপতি ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে দেশের যে কোনও প্রান্তে বিজ্ঞানের এই মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হত। অংশগ্রহণ করেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীরা।
বিশ্বের কোনও দেশেই এই ধরনের বিজ্ঞানের মহাসম্মেলনের খবর পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান কংগ্রেসের শতবর্ষ ২০১৪ সাল থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পৌরাণিক কিছু বিয়ষবস্তু, যেমন গণেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারি, মহাভারতের কর্ণের জন্ম স্টেম সেলের মাধ্যমে ইত্যাদি কিছু অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক কল্পনাপ্রসূত বিষয়কে উপস্থাপিত করার চেষ্টা চলছে। ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞান কংগ্রেসের গুরুত্বও হ্রাস পেতে থাকে।
বিজ্ঞান কংগ্রেসের সম্মেলনেই দাবি করা হয় পিথাগোরাসের উপপাদ্য আমাদের দেশের আবিষ্কার। এ ব্যাপারে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোবেল সমতুল্য ফিল্ডস পদক প্রাপক অধ্যাপক মঞ্জুল ভার্গব বলেছিলেন, ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ধারণা পেতে জানতে হবে মিশর দেশের তথ্য ও ইতিহাস, ভারতীয় জ্ঞান ও চিনদেশীয় তত্ত্ব। সম্মিলিত জ্ঞানই এই উপপাদ্যের সম্পূর্ণ ধারণা দেয়।’ ১৯২৭ সালে লাহোরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে জগদীশচন্দ্র বসু একই সুরে বলেছিলেন, জ্ঞানের অগ্রগতি একক জাতির অবদান নয়। বিভিন্ন দেশের জ্ঞানের অগ্রগতির সম্মিলিত ফল।
সেই বিজ্ঞান কংগ্রেস বন্ধ হয়ে গেল। বিকল্প হিসেবে হতে চলেছে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভাল। গো বিজ্ঞান হয়তো এই ধরনের ফেস্টিভালের মূল থিম হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চা নিয়ে অদ্ভুত একটা অবস্থা চলছে। সম্প্রতি চন্দ্রযান-৩ মিশন সফল হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে মহাকাশ বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে সাড়া পড়েছে। অন্যদিকে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন বিল পাশ হয়ে গেল। এই সংস্থাই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে বিজ্ঞান গবেষণার অভিমুখ।
পরিকল্পনা করা হয়েছে, আগামী ৫ বছরে গবেষণা ক্ষেত্রে ৫০,০০০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। যার মধ্যে বেসরকারি সংস্থা থেকে আসবে ৩৬,০০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের তথ্য বলছে গবেষণায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবদান ছিল মাত্র ০.৫ শতাংশ। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় স্বনির্ভরতার জন্য যে সংস্থাগুলো অর্থের অভাবে নিজেদের গতি হারাচ্ছে। গবেষণাতে খরচ ২০০৮ সাল থেকে দশ বছরে ২০১৮ সালে দেশের জিডিপির ০.৮৪ শতাংশ থেকে ০.৬৯ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। এমনকি পরিবেশের ওপর আঘাত এসেছে এই সময়কালে। জৈববৈচিত্র্যে অনন্য আমাদের দেশ। এ সম্পদ মানবজাতির সম্পদ। এর রক্ষাকবচে আদেশে রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবেশ আইন। করোনাকালে ২০২০ সালে প্রথম সংশোধন হল পরিবেশের প্রভাবের ওপর আইন। ২০২১ সালে অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০) এবং জৈববৈচিত্র্য সংশোধনী বিলের মাধ্যমে সংশোধন করা হল পুরোনো ধারাগুলোর। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রকৃতির শৃঙ্খলা, পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব। লাভবান হবে একমাত্র ব্যবসায়িক সংস্থা। দেশে বিজ্ঞান চেতনার কী হবে?
(লেখক জনবিজ্ঞান কর্মী, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চ। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)