- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
কখনো-কখনো মাত্র কয়েকটি দিনের ঘটনাবলি আমাদের গভীরভাবে বাস্তব অবস্থাটা চিনিয়ে দেয়। বাইশে জানুয়ারি থেকে পয়লা ফেব্রুয়ারি, এই দশটা দিন মোদি সরকারের দশ বছরের ছবিটা দেশের সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দিল।
বাইশে জানুয়ারি অযোধ্যায় হয়ে গেল রাম মন্দিরের উদ্বোধন। মন্দির নির্মাণ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের রায়ের ভিত্তিতে, তাই মন্দির নির্মাণ নিয়ে বড় কোনও বিরোধ দেশের কোথাও দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘ রায়ে দুটো কথা কিন্তু স্পষ্টভাবে বলা ছিল। প্রথমত, কোনও মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি হয়েছিল এমন কোনও পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, বাবরি মসজিদ ভাঙার ব্যাপারটা ছিল একটা গুরুতর অপরাধ। তবুও মসজিদের জমি মন্দিরের জন্য দিয়ে মসজিদের জন্য আলাদা করে জমির ব্যবস্থা করে সুপ্রিম কোর্ট আশা করেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তির একটা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত করা যাবে।
অযোধ্যার পর যেভাবে কাশী, মথুরা এবং আরও অনেক জায়গায় মন্দিরের নামে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু হয়েছে এবং যেভাবে ১৯৯১ সালের ধার্মিক উপাসনাস্থল আইনকেই বাতিল করে দিয়ে গোটা দেশজুড়ে অন্য ধর্মের উপাসনাস্থলে মন্দির গঠনের ছক কষা হচ্ছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের আশা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর রাম মন্দির নিয়ে কোনও বিরোধ হয়নি, তবুও মন্দির উদ্বোধনের উৎসব উদযাপনের নামে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে মুসলিম সহ নাগরিকদের ওপর হিংসা ও হামলার রিপোর্ট এখনও আসছে। গত বছর আঠাশে মে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হয়েছিল আর বাইশে জানুয়ারি হল রাম মন্দির উদ্বোধন। দুই উদ্বোধনের তুলনামূলক ছবিটা একটু দেখা যাক।
সংসদের উদ্বোধন ছিল একটি সাংবিধানিক কর্মসূচি। সেখানে সবার আগে উপস্থিত থাকার কথা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর। তাঁকে আমন্ত্রণই জানানো হল না। উলটে আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ধর্মগুরুদের ব্যাপক উপস্থিতি। সংবিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত সংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠা করা হল রাজতন্ত্রের প্রতীক রাজদণ্ড সেঙ্গল। সংসদীয় গণতান্ত্রিক একটি অনুষ্ঠান ধার্মিক রাজতন্ত্রের চেহারা নিয়ে নিল। অন্যদিকে মন্দির উদ্বোধন পুরোপুরি একটি ধার্মিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে আমরা দেখলাম ধর্মগুরুরা অনুপস্থিত, প্রশ্ন উঠল মন্দিরের অসম্পূর্ণতা এবং অন্য অনেক শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ নিয়ে। হিন্দু ধর্মগুরুদের অনেকের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হল। মনে হল আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে রাম মন্দির থেকেই শুরু হয়ে গেল মোদি সরকারের নির্বাচনি প্রচার অভিযান।
আজকাল প্রধানমন্ত্রীকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত বিভিন্ন পবিত্র দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা এবং রাম মন্দির ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রায়ের চোখে মোদি নিজেই বিষ্ণুর একাদশতম অবতার। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রীর সংসদ, বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থা, সংবাদমাধ্যম ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথা। এর মধ্যে কথায় কথায় ঈশ্বরকে টেনে আনলে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের কতটা আর অবশিষ্ট থাকে? রামকে ভারতের জাতীয় প্রতীক, অযোধ্যাকে জাতীয় তীর্থকেন্দ্র হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ভারতের বা এমনকি হিন্দুধর্মের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ? সরকার তার দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যদি বাজারের হাতে জনগণকে ছেড়ে দেয় আর জনগণের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে ভোটের রাজনীতিতে টেনে আনে তাহলে এই উলটো পথে দেশের এবং ব্যাপক জনগণের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এ বছর সাধারণতন্ত্র দিবসের চুয়াত্তরতম বার্ষিকীতে ঘুরেফিরে এই প্রশ্নই আলোড়ন তুলেছে ব্যাপক জনমানসে।
গত বছরের শেষে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আমরা দেখেছিলাম দুজন তরুণকে সংসদের দর্শক গ্যালারি থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং যুবসমাজের অন্ধকার ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। সেই দুজন তরুণ কর্ণাটকের এক বিজেপি সাংসদের সৌজন্যে প্রবেশপত্র জোগাড় করেছিল। কিন্তু বিরোধী পক্ষের সাংসদরা যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র কাছ থেকে এ ব্যাপারে জবাব চাইলেন, তখন প্রায় সমস্ত বিরোধী সাংসদকে লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে সাসপেন্ড করা হল। অন্যদিকে, সেই দুজন তরুণ ও তাদের আরও চারজন সঙ্গীকে ইউএপিএ আইনে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে পুরে দেওয়া হল জেলে। এবার দিল্লির এক আদালতে সেই গ্রেপ্তার তরুণরা জানিয়েছে কীভাবে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে জোর করে খালি পৃষ্ঠায় তাদের কাছ থেকে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে বিভিন্ন বিরোধী দল ও নেতাদের এ ব্যাপারে অভিযুক্ত করে তোলা যায়। ষড়যন্ত্র ও নিপীড়নের ভিত্তিতে শাসন পরিচালনার এই ছক ব্রিটিশ রাজকেও হার মানায়।
মোদি সরকার মানে ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ, সেখানে কোনও বিজেপি-বিরোধী সরকারের থাকা মানা। মহারাষ্ট্রের পর নীতীশ কুমারকে কাজে লাগিয়ে বিহারে আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে বিজেপি। যে নীতীশ কুমারের জন্য বিজেপির দরজা চিরকালের মতো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল সেই দরজাই আবার খুলে গেল নির্বাচনের আগে। ক্ষমতা কবজা করা ছাড়াও একটা অন্য বড় ছক আছে এর পিছনে। বিগত কয়েক মাসে বিহার শুধু বিরোধী ঐক্যের সূত্রপাত ঘটায়নি, এক বিকল্প অ্যাজেন্ডা উঠে আসছিল বিহার থেকে। জাতিভিত্তিক জনগণনা, সংরক্ষণের সম্প্রসারণ, ভয়াবহ দারিদ্র্যের ছবিকে পর্দা সরিয়ে সামনে নিয়ে আসা এবং স্থায়ী সরকারি চাকরির দরজা খুলে দেওয়া- এ শুধু বিহারের জন্য নয়, গোটা দেশের জন্য এক অন্য দিশা তুলে ধরছিল। সেই দিশাকে আটকাতে নীতীশ কুমারের সঙ্গে আবার জোট বেঁধেছে বিজেপি।
শুধু বিহার নয়, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে জেলে পাঠিয়ে সরকার উলটে দেওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। হেমন্ত সোরেন যদি হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা শুভেন্দু অধিকারীর পথ বেছে নিতেন তাহলে কোনও দুর্নীতির প্রশ্ন উঠত না। হেমন্ত যদি নীতীশ কুমারের মতো ডিগবাজি খেতে রাজি থাকতেন তাহলে তাঁকে লুফে নিত বিজেপি। কিন্তু হেমন্ত তা করেননি বলে সাঁওতাল পরগনা ও ছোটনাগপুরের আদিবাসী রাজনীতির ময়দানে নাগপুরের পতাকা উড়িয়ে এখনও বিজেপি জমি দখল করে নিতে পারেনি। চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনেও দেখা গেল কংগ্রেস-আপ জোটের আটটি ভোট বাতিল করে দিয়ে প্রকাশ্য কারচুপির মাধ্যমে মেয়রের পদ তুলে দেওয়া হল বিজেপির হাতে। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে ক্ষমতার এই অহংকার ও অট্টহাস্য ততই ভারতের সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করবে।
আর এমন অবস্থায় বাজেট ও অর্থনীতির হিসেব কী দাঁড়াতে পারে তা বলাই বাহুল্য। বাজেট ভাষণে দাবা খেলায় ভারতে বৈপ্লবিক অগ্রগতির কথা শোনা গেল, শোনা গেল না শুধু চাকরি বা কর্মসংস্থানের কথা। বাজেটের ঠিক আগে রিজার্ভ ব্যাংকের এক সার্ভেতে দেখা গেল, মাসে পঞ্চাশ হাজার বা এক লক্ষের বেশি উপার্জনকারী পরিবারের অনেকেই আর্থিক উন্নতির কথা বললেও নিম্ন আয়ের অধিকাংশ পরিবারের স্পষ্ট মত, আর্থিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। বিহারের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার মাসিক দশ হাজার টাকার কম আয়ে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটায়। গোটা দেশের ছবিটা কমবেশি একই রকম। ধনকুবেরদের থেকে কর আদায়ের কোনও চেষ্টা সরকারের নেই, রাজস্ব আসছে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা জিএসটি থেকে। কথা ছিল, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের দ্বিগুণ আয় এবং সকলের জন্য পাকা বাড়ি। তার কোনও হিসেব আজ নেই, নতুন স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে ২০৪৭ সালে ভারত বিকশিত দেশ হয়ে উঠবে। ফাঁপা বুলি আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে আর কতদিন দেশ ডুবে থাকবে?
(লেখক সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক। মত নিজস্ব