রূপায়ণ ভট্টাচার্য, ফতেপুর সিক্রি: চোখমুখ, মাথা ঝলসে যাচ্ছে চারদিকের রোদে। ফতেপুর সিক্রির (Fatehpur Sikri) ঐতিহাসিক দুর্গের অনেকটা আগে একটা বিশাল পার্কিং প্লেসে গাছের তলায় ছড়ানো-ছেটানো কিছু চেয়ার। যৎসামান্য ছায়ায় বসে জনা দুই তরুণের সঙ্গে কথা বলছি। তখনই অন্যদিক থেকে ছুটে এলেন আরও জনা পাঁচেক। অজানা মানুষের সামনে তাঁদের গলায় যথেষ্ট উত্তেজনা।
কিছুক্ষণ আগে একেবারে ঠিক বুলন্দ দরওয়াজার সামনে কিছু দোকানদারের সঙ্গে দেখা। রঙিন ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়েছেন। অতি সামান্য বিক্রিবাটা। তাঁদের গলা উপচে পড়ে হতাশা। একে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা, তারপর ভোট। পর্যটক কোথায়?
এই প্রসঙ্গেই ওই তরুণের দল রে-রে করে উঠল। কোথায় পর্যটক? ফতেপুর সিক্রিকে তো পরিকল্পনা করে মেরে ফেলা হচ্ছে, সোচ্চার তাঁরা। এঁরা সবাই অনুমোদিত গাইড। সবচেয়ে উত্তেজিত তরুণের গলা চরমে, ‘দেখছেন তো শুনসান করছে চারদিক। সব লোক তাজমহল দেখে অতীতে ফতেপুর সিক্রি, সিকান্দ্রা দেখে বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন তাজমহলের দশ শতাংশ পর্যটক এই দুটো জায়গায় আসেন কি না সন্দেহ। সিকান্দ্রা’র অবস্থা আরও খারাপ। এখানে চারশোজন গাইড। একটা পরিবার এলে তাঁদের নিয়ে ঝগড়া করি। দিনে চারশো টাকাও হয় না। কীভাবে চলবে বলুন?’
নানা অভিযোগ তাঁদের। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ নামেই, ফতেপুর সিক্রির উন্নয়নে রাজ্য সরকার আর কিছু করছে না। দ্বিতীয় জনের গলায় ক্ষোভ, সরকারি অফিসগুলো আর খোলা থাকে না। ‘এদের কাজ বলতে কয়েকটা ডাস্টবিন রেখে দেওয়া। এই ডাস্টবিনগুলো প্রতিদিন আবার শুয়োরের দল এসে উলটে দিয়ে যায়। কেউ দেখার নেই।’ সত্যিই দেখা গেল, কয়েকটা শুয়োরের দল এগিয়ে আসছে।
আরও কিছুক্ষণ কথা চালানোর ফাঁকে উত্তরপ্রদেশের এক অদ্ভুত সমস্যা উঠে এল ফতেপুর সিক্রির প্রান্তরে। চোদ্দো বছর জায়গাটা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী। মোগলদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত সম্রাট আকবর এখানেই মুসলিম, হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলন ঘটান অবিশ্বাস্যভাবে। মোগলদের প্রথম পরিকল্পনামাফিক নগরী এটাই।
স্বাধীন ভারতে বোধহয় প্রথম এমন অভিযোগ উঠছে যে, আকবরের স্মৃতির রাজধানীর গুরুত্ব কমিয়ে দিতে চাইছে রাজ্য ও কেন্দ্র মিলে। অযোধ্যার রাম জন্মভূমি, মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি ও বৃন্দাবনকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। গাইডদের ভিড়ে কথাটা অনেকবার উঠল বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ‘সবাই তো তাজমহল আর আগ্রা দুর্গ দেখে সটান মথুরা, বৃন্দাবনে চলে যাচ্ছেন। তারপর এখন হয়েছে রাম জন্মভূমির মন্দির!’ গলায় বিদ্রুপ স্পষ্ট, হতাশাও।
সত্যিই তেমন পর্যটক চোখে পড়ল না ফতেপুর সিক্রিতে। বিশাল চৌহদ্দির মধ্যে দুপুর বারোটা নাগাদ একটা মাত্র পর্যটকদের বাস এসেছিল। আগ্রা জেলার মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বাস। বুলন্দ দরওয়াজার লাগোয়া প্রাচীরের পাশে একটা ছোট্ট গেট রয়েছে। সেই গেট দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে অন্য জগৎ অপেক্ষা করছে ভিতরে। গিজগিজ করছে বাড়ি। কয়েক হাজার লোক। এই গাইডদের অধিকাংশের বাড়ি ওখানে। স্পষ্ট বলছেন, ভোট দেবেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে।
আগ্রা, হাথরস ও ফতেপুর সিক্রির মধ্যে একমাত্র এখানেই বিজেপি একটু সমস্যায় পড়েছে। তাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন বিজেপি বিধায়ক বাবুলাল চৌধুরীর ছেলে। পার্টিতে ডামাডোল, বিজেপি শোকজ করেছে বিধায়ককে। এই কথাগুলোই টুকরো-টাকরা ভেসে আসছিল গাইডদের ভিড়ে। সামান্য দূরে ফতেপুর সিক্রি রেলস্টেশন। লাইনটা রাজস্থানের ভরতপুর, কোটা হয়ে রণথম্বরের দিকে চলে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখি, অতি ছোট একটা স্টেশন, একটা লোকও নেই প্ল্যাটফর্মে। ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্ম, ঢোকার গেট। সামনে অবশ্য ঠিক অমৃত ভারতের রঙিন ছবি ও পোস্টার। কবে তা হবে, কেউ জানে না। এদিকে দোকান নেই তেমন। যাত্রীও তেমন হয় না।
আগ্রা জেলায় উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) সবচেয়ে বেশি তপশিলি (২১ শতাংশ)। বলা হয়, উত্তরপ্রদেশের দলিতদের রাজধানী। আজ মায়াবতী ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের হয়ে বলার কোনও নেতা নেই। আকবর তাঁর স্বপ্নের রাজধানী তৈরি করেও ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন লাহোরে। অনেকে বলেন, জলের অভাবে। আজও অনেক বাসিন্দাকে বলতে শোনা গেল জলের কষ্টের কথা। হতেই পারে।
বুলন্দ দরওয়াজার নীচে দাঁড়ালে সামনের পটভূমিকে দেখায় রাজস্থানের মতো। উঁচুনীচু বালিয়াড়ি, মাঝে মাঝে বাবলা জাতীয় গাছ। বেশ রুক্ষ জায়গাটা। বৈশাখী দুপুরে পর্যটকশূন্য হয়ে দাঁড়ানোয় আরও রুক্ষ দেখাচ্ছে। আগ্রায় খোঁজ নিয়ে জানলাম, সত্যিই সিকান্দ্রা’য় পর্যটক কমেছে। সেখানেই শেষশয্যায় শুয়ে আকবর। তার মানে ধর্মনিরপেক্ষ আকবরের রাজধানী ও সমাধি দেখার আগ্রহ কমছে। তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না।
উত্তরপ্রদেশ সরকার পর্যটকদের হিসাব কষতে গিয়ে রাজ্যকে নয় ভাগে ভাগ করেছে। অযোধ্যা, বারাণসী, প্রয়াগরাজ, লখনউ, আগ্রা, মিরাট, ঝাঁসি, বেরেলি ও গোরখপুর। ২০২৩-এর হিসেব একটু তুলে দিই। বারাণসীতে ১২ কোটি ৯৪ লক্ষ। আগ্রায় ১০ কোটি ৫০ লক্ষ। অযোধ্যায় এসেছিলেন ৬ কোটি ৩০ লক্ষ। প্রয়াগে ৫ কোটি ৩৯ লক্ষ। লখনউতে ২ কোটি ৩১ লক্ষ। বিদেশি পর্যটকদের টানায় অনেক এগিয়ে আগ্রা। গাইডদের মূল ক্ষোভ, ফতেপুর সিক্রিকে তুলে না ধরায় বিদেশি পর্যটকরাও আর ৩৬ কিলোমিটার উজিয়ে ওদিকে যাচ্ছেন না।
২০১৫ থেকে ২০১৯- পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান আরও কৌতূহল জাগায়। বলে দেয়, হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে যোগীরাজ কতটা সফল উত্তরপ্রদেশে। বৃন্দাবন ও মথুরা এমনিতে আগ্রার পর্যটন অঞ্চলে পড়ে। আগে সেখানে ভক্তরা যেতেন। এখন সেখানে অনেক বাড়তি সুবিধা, প্রচার বেশি। হিসেব দেখাচ্ছে, পর্যটক টানায় প্রতিবার বৃন্দাবন ও গোবর্ধন হারিয়ে দিয়েছে আগ্রাকে। ফতেপুর সিক্রি তো বহু বহু পিছনে। বৃন্দাবনে ২০১৫ সালে ১ কোটি ২৬ লক্ষ লোক এলে গোবর্ধনে গিয়েছিলেন ১ কোটি ২০ লক্ষ, আগ্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ। ফতেপুর সিক্রি? মাত্র ৮ লক্ষ ১৪ হাজার ৭৬১। ফারাকটা থেকে গিয়েছে প্রতিবার। এককালের ভারতের রাজধানীর পর্যটক সংখ্যা কমেই চলেছে দিন-দিন।
চড়া হিন্দুত্বের গোবলয়ে রাম জন্মভূমি, গোবর্ধনের কাছে দাঁড়িয়ে হারছে ফতেপুর সিক্রি। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দরজা, আকবরের গুজরাট জয়ের প্রতীক ‘জয়ের সিংহদ্বার’ বুলন্দ দরওয়াজার উপরে পার্সিতে লেখা একটা কথা। ‘মেরির ছেলে যিশু বলেছিল, পৃথিবীটা একটা সেতু। সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যাও। তার ওপরে বাড়ি বানিও না।’ কী চমৎকার উপলব্ধি! সামান্য দূরে, অনুপ তালাওয়ের মাঝখানে বসে বহু যুগ আগে সুর ছড়িয়ে দিতেন তানসেন। নবরত্ন সভায় রসিকতার আলো ছড়াতেন বীরবল। তাঁর বাড়িটাও আছে সেখানে। সেসব দেখার আর তেমন আকুতি নেই আজকের উত্তরপ্রদেশে।