চাঁদকুমার বড়াল, কোচবিহার : গত বছরের এই সময়টায় কোচবিহারের ১০টি মিল মিলে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনেছিল। এবারে ধানের পরিমাণ কমে মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন হয়েছে। পার্থক্যটা চোখ কপালে তোলার মতোই। ফড়েদের হাত ধরে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি জেলার ধান বিহারে যাওয়াতেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেশি দাম মেলায় বিহারে ধান পাঠানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে। এর জেরে সরকার সহায়কমূল্যে ধান পাচ্ছে না। চালের মিলগুলি ধুঁকছে। বিহারে ধান পাঠানোর এই প্রবণতা জারি থাকলে কোচবিহার সহ উত্তরবঙ্গে চালের সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা ছড়িয়েছে।
পরিস্থিতি আঁচ করে চাল ব্যবসায়ীরা যথেষ্টই উদ্বিগ্ন। কোচবিহার রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ভরতভূষণ আগরওয়াল বললেন, ‘সরকার ধান কিনতে পারছে না। সরকারি মান্ডিগুলি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে চালকলগুলি সমস্যায় পড়বে। বিহারে চাল পাঠানোর এই প্রবণতা রুখতে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবেই চালকলগুলি বাঁচবে, নইলে বড়সড়ো সমস্যা দেখা দেবে।’ সমস্যার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানিয়ে তাঁরা খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরে চিঠি দিচ্ছেন বলে ভরত জানান। চালকল মালিক সুন্দরলাল চোপড়া বললেন, ‘কোচবিহারের ধান বিহারে চলে যাচ্ছে। এর ফলে জেলায় চালের অভাব দেখা দিতে পারে। গত বছর এই সময় জেলার ১০টি মিল মিলে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনেছিল। এবছরের পরিসংখ্যায় ভীষণই খারাপ। এপর্যন্ত ১০টি মিল মিলে মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে।’
খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তর রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলাতেও কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান কেনা শুরু করেছে। ১ জুন থেকে এই ধান কেনা শুরু হয়েছে। তবে এবারের মরশুমে সহায়কমূল্যে ধান কেনার গতি একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। ধান কেনা শুরুর পর এক মাস হয়ে গেলেও কৃষকরা সরকারের কাছে সেভাবে ধান বিক্রি করতে আসছেন না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে যথেষ্টই চিন্তায় ফেলেছে। কী কারণে এই সমস্যা? তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ধানের বিক্রয়মূল্যে ফারাকের জন্যই কৃষকরা সহায়কমূল্যে ধান বিক্রিতে সেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সহায়কমূল্যে প্রতি কুইন্টাল ধানের জন্য ২০৬০ টাকা দাম মিলছে। খোলাবাজারে ধান বিক্রি করলে কুইন্টাল প্রতি ২২০০ টাকা পর্যন্ত দাম মিলছে। এর জেরেই কৃষকরা খোলাবাজার বা ফড়েদের কাছে ধান বিক্রিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কৃষকবন্ধু অ্যাকাউন্ট ছাড়া এখন সরকারের কাছে ধান বিক্রি করা যায় না। কৃষকদের একাংশের অভিযোগ, বিষয়টি তাঁদের কাছে যথেষ্টই জটিল। একারণেও তাঁরা সহায়কমূল্যে ধান বিক্রিতে সেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
কোচবিহার জেলাকে সবমিলিয়ে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনতে হবে। তবেই তাহলে তারা এবারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। কোচবিহার জেলায় খাদ্য দপ্তর ২৫টি ধান ক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। ১ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত কোচবিহার জেলা খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তর প্রায় ৬০০ মেট্রিক টন ধান কিনেছে। কোনও স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও সোসাইটি ধান কিনতে পারেনি। আলিপুরদুয়ার জেলাকে প্রায় ১৬ হাজার মেট্রিক টন কিনতে হবে। জেলায় ১০টি ধান ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ১ জুন থেকে এক মাস ধরে তারা মাত্র ২৫০ কুইন্টাল ধান কিনতে পেরেছে। জলপাইগুড়ি জেলাকে ৩৭ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনতে হবে। জেলায় ১৭টি ধান ক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দপ্তর কৃষকদের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত সেভাবে ধান কিনতে পারেনি। সমস্যা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি জোরালো হয়েছে।
সহায়কমূল্যে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বোরো ধান কেনা হবে। এই সময়ের মধ্যে কীভাবে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে তা খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দপ্তর সূত্রে খবর, আপাতত তাদের কাছে যে পরিমাণ চাল মজুত আছে তা দিয়ে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জেলার গণবণ্টন ব্যবস্থা, মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারের কাজ চলবে। তবে তারপর সমস্যা হতে পারে। নভেম্বর মাস থেকে আমন ধান কেনা শুরু হবে। কিন্তু আপাতত সমস্যা মেটানোই দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।