পুরাতন মালদা: মেলার নাম জুয়াড়ি মেলা। রাজ্যে এমন আজব মেলার হদিস দ্বিতীয় নেই৷ ফুচকা-জিলিপি-পাঁপড়ভাজার দোকানের সঙ্গেই রয়েছে পাশা, তাস, চক্রর মতো একাধিক জুয়া খেলার বোর্ডের সহবস্থান। শুধু পুরুষরা নয়, এই মেলায় অংশ নেন বাড়ির মেয়ে-বউরাও। বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক আর সবচেয়ে ছোট সদস্য অভিভাবকদের সঙ্গে একই বোর্ডে জুয়া খেলে। সেই দৃশ্যও চোখে পড়ে আকছার। সকাল থেকে শুরু হওয়া মেলা আগে রাতভর চললেও এখন সন্ধে পর্যন্ত চলে জুয়া খেলা। এই মেলায় কোনও পুলিশি নিষেধাজ্ঞা নেই৷ বড়লোক-গরিব ভেদাভেদও নেই। পুরাতন মালদার বাসিন্দারা এই আজব মেলার সাক্ষী কয়েক প্রজন্ম ধরে। মেলা বসে পুরাতন মালদা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোকাতিপুরে। আমবাগানের মধ্যে। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে বেহুলা নদী। লোকশ্রুতি, একসময় লখিন্দরের দেহ নিয়ে এই নদী দিয়েই ভেসে গিয়েছিল বেহুলার ভেলা। সম্ভবত সেকারণেই মনসামঙ্গল কাব্যেও এই মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মুলাষষ্ঠী তিথিতে প্রাচীন সময় থেকেই এই মেলা চলে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘুম থেকে উঠেই নিজের পকেটে রেস্তের খোঁজ নিতে ব্যস্ত আট থেকে আশি। সকালে শুরু হয় ষষ্ঠীপুজো। তারপরেই বসে জুয়ার আসর। শুধু মালদা কিংবা অন্যান্য জেলা থেকে নয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, এমনকি অসম থেকেও অনেকে এই মেলায় অংশ নিতে আসেন অনেকে।
মেলার কাহিনী অতি প্রাচীন। তুর্কি শাসনকালে পুরাতন মালদায় ছিল ঘন জনবসতি। তখনও মালদা শহরে সেভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। শোনা যায়, সেইসময় মোকাতিপুর এলাকায় ঘন জঙ্গল। জন্তু জানোয়ারের বাস। বাঘের ভয়ে দিনদুপুরেও ওই এলাকায় যাওয়ার সাহস পেত না কেউ। সেই জঙ্গলেই ছিল ষষ্ঠীদেবীর বেদি। তাই ঘরের মেয়ে-বউরা যখন মুলাষষ্ঠী তিথিতে সেই বেদিতে পুজো দিতে যেতেন, তখন পুরুষরা দল বেঁধে তাঁদের পাহারা দিতেন। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত চলত পুজো। পুরুষরা অতক্ষণ একভাবে বসে থাকতে না পেরে সময় কাটাতে শুরু করেন জুয়া খেলা। সেই শুরু। এখন তা হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য। আগে শুধু পুরুষরা এই মেলায় অংশ নিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে মহিলারাও জুয়া খেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন৷ এই মেলা নিয়ে পুলিশ কোনও প্রতিক্রিয়া দেয় না। অনেক পুলিশকর্মীকেও মেলায় দেখা যায়। তবে রাত ১০টার মধ্যেই মেলা শেষ করার অলিখিত পুলিশি নির্দেশ থাকে।
পুলিশের বক্তব্য, ঐতিহ্যের কাছে বৈধ-অবৈধ প্রশ্ন বোধহয় অনেক সময়ই ফিকে হয়ে যায়। অবশ্য কয়েকশো বছরের পুরোনো এই মেলায় আজ পর্যন্ত কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মেলার এক উদ্যোক্তার কাছে জানা গিয়েছে, কয়েক ঘণ্টার মেলায় দেড় থেকে দু’কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়।