সমীর দাস, কালচিনি: অপেক্ষা করতে করতে এক সময় হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশাটুকুও ফুরিয়ে গিয়েছিল কালচিনির (Kalchini) এক চা বাগানের শ্রমিক দম্পতির। কিন্তু অদৃষ্টে কী রয়েছে, সেটা বোঝা কার সাধ্যি? এক-দুই নয়, প্রায় ১০ বছর বাদে সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেলেন তাঁরা। নেপথ্যে সিকিমের (Sikkim) নামচি এলাকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং কালচিনি থানার পুলিশ (Kalchini police station)।
দিনদুয়েক আগে ওই দম্পতি মেয়েকে ফিরে পাওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন। তারপর থেকে বাড়িতে প্রস্তুতি চলছিল জোরকদমে। কিশোরীর বাবা বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় মেয়ে আমার মুরগির মাংস খেতে খুব ভালোবাসত। এতদিন বাদে মেয়ে বাড়ি ফিরছে। তাই সকাল সকাল বাজারে গিয়ে মুরগির মাংস কিনে এনেছি।’
মঙ্গলবার রাতে কালচিনি থানায় মেয়েকে সামনে পেয়ে আবেগে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল বাবা-মায়ের। মনে আশঙ্কা ছিল, সন্তান এতবছর বাদে যদি তাঁদের চিনতে না পারে? তবে সমস্ত দুশ্চিন্তা কেটে গেল এক লহমায়, যখন সহজেই সে চিনে নিল বাবা-মাকে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল ওরা।
এখন নাবালিকার বয়স ১৬ বছর। আইনি প্রক্রিয়া মেনে পুলিশ দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছে তাকে। এরকম আরও অনেক নাবালক, নাবালিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের বাবা-মায়েরা। এই ঘটনার পর তাঁদের মনের কোনায় আশার আলো ফুটে উঠেছে।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেয়ের যখন ৬ বছর বয়স, তখন এক পরিচিতর মাধ্যমে মেয়েকে সিকিমে পাঠিয়েছিলেন বাবা-মা। অভাব-অনটনের সংসারে দু’বেলা পেট ভরে খেতেও পেত না সে। তাই একটু ভালো খাওয়া, পড়াশোনার আশ্বাস পেয়ে ফাঁদে পা দেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। সেই মেয়েকে যে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে তাকে পরিচারিকার কাজে লাগানো হয়েছিল। এরপরই শুরু হয় অত্যাচার। সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছিল নাবালিকা।
মাস দুয়েক আগে সুযোগ পেয়ে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। পথে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে নিজের ঠিকানাও সঠিকভাবে বলতে পারছিল না সেসময়। শুধু কালচিনির কথা আবছা মনে ছিল। সেই সূত্র ধরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে কালচিনি থানায় যোগাযোগ করা হয়। এরপর কালচিনি থানার পুলিশ কিশোরীর পরিবারের খোঁজ শুরু করে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সমাজকর্মীদের মাধ্যমে ওই দম্পতির খোঁজ পেয়ে তাঁদের মেয়ের ছবি দেখানো হয়। চিনতে ভুল করেননি অভিভাবকরা। এরপরই কালচিনি থানার পুলিশ সিকিম থেকে কিশোরীকে উদ্ধার করে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। মঙ্গলবার রাতে মেয়েকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন বাবা-মা। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি।
কালচিনি থানার ওসি গৌরব হাঁসদা জানিয়েছেন, কিশোরীকে তার বাবা ও মায়ের হাতে নিয়ম মেনে তুলে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে কোনও সমস্যা হলে পুলিশ পরিবারকে সহযোগিতা করবে। এদিকে কিশোরীর বাবা-মা বললেন, ‘বিশ্বাস করে একজনের কাছে মেয়েকে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে তাঁর আর খোঁজ মেলেনি। আশপাশের সবাইকে বলব, আমাদের মতো কেউ যেন নিজের সন্তানকে অন্য জায়গায় না পাঠান।’
ঘটনা প্রসঙ্গে কালচিনির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদক কমল কুজুরের মত, চা বলয়ের মানুষের সন্তানদের নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে। সংস্থার তরফে প্রচার চলছে যাতে বাইরে কেউ ছেলেমেয়েকে না পাঠান। যারা এখনও বাইরে, তাদের ফেরাতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।