প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমানঃ জাল চালান তৈরি করে বালি পাচার এই রাজ্যে নতুন কোন ঘটনা নয়। আর এবার সামনে এল একেবারে খোদ ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যানের জাল অনুমতিপত্র। এই জাল অনুমতিপত্র ব্যবহার করে দামোদরের বুকে বালি খাদানে অবৈধ কারবার চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। এমন বেনজীর জালিয়াতির স্পর্ধা যিনি দেখিয়েছেন তিনি হলেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের চক্ষণজাদি গ্রামের আব্দুল আজীম মল্লিক। তবে অবশ্য রক্ষা হয় নি। প্রশাসনিক তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণ হয়ে যাবার পর ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক তার বিরুদ্ধে জামালপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে জাল নথিপত্র তৈরি করে প্রতারণার ধারায় মামলা রুজু করে থানা। কিন্তু আব্দুল আজীমকে এখনও গ্রেপ্তার না করায় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।
এ হেন অভিযুক্ত আব্দুল আজীম মল্লিক হঠাৎতই মঙ্গলবার বর্ধমান সিজেএম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তার জামিনের জন্য আদালতে আবেদন করেন আইনজীবী পার্থ হাটি। জামিনের সওয়ালে তিনি বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্তকে নোটিশ পাঠিয়ে তদন্তকারী অফিসার ডেকে পাঠান। নোটিশ পাওয়ার পর অভিযুক্ত তদন্তকারী অফিসারের কাছে হাজির হয়েছিল। তদন্তে সব ধরণের সাহায্য করেছে অভিযুক্ত। তাই যে কোনও শর্তে আব্দুল আজীম মল্লিকের জামিন মঞ্জুর করা হোক’। অভিযুক্তের আজীমের জামিনের জন্যে তার আইনজীবী পার্থ হাটি এমন সওয়াল করলেও জামিনের বিরোধীতা করেন নি সরকারি আইনজীবী। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সপ্তাহে একদিন তদন্তকারী অফিসারের কাছে হাজিরা, অভিযোগকারীকে ভীতি প্রদর্শন না করা এবং মামলার নির্ধারিত দিনে আদালতে নিয়মিত হাজিরার শর্তে সিজেএম আত্মসমর্পণকারীর জামিন মঞ্জুর করেন।
দামোদরের বুকে বালি খাদান চালুর জাল অনুমতি পত্র তৈরির বিষয়টি ছোট খাটো কোন জালিয়াতির ঘটনা নয়। এত বড় একটা জালিয়াতি কাণ্ড প্রকাশ্যে আসায় যথেষ্ট চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, চক্ষণজাদি গ্রামে ফুটবল মাঠ ও স্কুল লাগোয়া একটি জায়গায় আজীম বালি খাদান খোলার অনুমতি পেয়েছে বলে এলাকায় প্রচার হয়। এনিয়ে প্রায় শ’খানেক বাসিন্দা ’ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের’ চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ জানান। সেই অভিযোগে বাসিন্দারা জানান, “যেখানে বালি খাদান খোলার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে আজীম দাবি করছে, তার খুব কাছেই রয়েছে খেলার মাঠ, হাইস্কুল ও নদী বাঁধ। ওই জায়গায় বালি খাদান খোলার অনুমতি দেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে প্রভূত সমস্যা দেখা দেবে। গ্রাম বিপন্ন হবে“।
এমন অভিযোগ পাওয়ার পরেই নড়ে চড়ে বসেন ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কের্পারেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান। অনুমতিপত্র খতিয়ে দেখে সেটি জাল অনুমতি পত্র বলে চেয়ারম্যান নিশ্চিৎ হন। এ ধরণের কোনও অনুমতিপত্র যে কাউকে দেওয়া হয়নি, তাও তিনি সাফ জানিয়ে দেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে চেয়ারম্যান পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক ও পুলিস সুপারকে চিঠি দেন। তার পরেই জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক গ্রামবাসীদের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জামালপুরের বিডিও এবং ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিককে নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পেয়ে ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক প্রত্যুষ বাগ জামালপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে জাল নথিপত্র তৈরি করে প্রতারণার ধারায় মামলা রুজু করে থানা। এমন কি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্তকে নোটিশ পাঠিয়ে ডেকে পাঠায়। তদন্তকারী অফিসার তাপস শীলের নোটিশ পেয়ে গত ২১ নভেম্বর থানায় হাজির হয় অভিযুক্ত। কিন্তু তদন্তকারী অফিসার শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করেই আজীম কে ছেড়ে দেয়।
এদিকে এই ঘটনা সামনে আসার পর রাজ্যের শাসক দল ও প্রশাসনকে বিঁধতে ছাড়েন নি বিজেপি নেতারা। বিজেপির জেলা নেতা জীতেন্দ্রনাথ ডকাল বলেন, ‘লুটেরাদের রাজত্বে সবই সম্ভব। দামোদর থেকে বালি লুটের ব্যাপারে জামালপুর শীর্ষ স্থানে রাখলে ভুল কিছু হবে না। ’গ্রীন ট্রাইবুনালের’ নির্দেশ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এই ব্লকে দিনে ও রাতে দামোদর থেকে বেপরোয়া ভাবে বালি উত্তোলন চলছে। এমনকি সরকারী ভাবে অনুমোদিত বালি খাদানের বাইরেও বালি খাদান তৈরি করে বালি পাচার চলছে। এর জন্যে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হলেও অদ্ভুত ভাবে সবাই নীরব রয়েছেন’।