প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: ‘টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন’ বিতর্কের মোড় বৃহস্পতিবার একাই ঘুরিয়ে দিলেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এথিক্স কমিটির ডাকে এদিন মহুয়া মৈত্র’র হাজিরাকে কেন্দ্র করে প্রবল উত্তপ্ত হল সংসদের অ্যানেক্স ভবন। মহুয়াকে ‘ব্যক্তিগত’ এবং ‘অবমাননাকর’ প্রশ্ন করার অভিযোগে কমিটির বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান তৃণমূল সাংসদ। তাঁর সমর্থনে বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করেন সমস্ত বিরোধী সাংসদেরা। শুধু ওয়াকআউট করেই ক্ষান্ত হননি তাঁরা, সংসদের অ্যানেক্স ভবনে রীতিমতো হইহট্টগোল বাঁধিয়ে দেন মহুয়া সহ বসপা সাংসদ দানিশ আলি, কংগ্রেস সাংসদ উত্তম রেড্ডি, সিপিএম সাংসদ পিআর নটরাজনের মতো বিরোধী নেতারা। গোটা বিষয় নিয়ে প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়েছেন এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ কুমার সোনকার সহ তামাম গেরুয়া শিবির। জানা গিয়েছে, সংসদীয় নীতি কমিটির বৈঠকে এক মহিলাকে অনৈতিক প্রশ্ন করার অভিযোগে কমিটি চেয়ারম্যান সোনকার সহ জনা কয়েক শাসক দলীয় সদস্যের অসংসদীয় এবং অবমাননাকর আচরণের অভিযোগে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লার কাছে চিঠি পাঠিয়ে নালিশ ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপের দাবি করতে চলেছে বিরোধী শিবির৷ এককথায়, মহুয়া মৈত্র’র বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পালটা কমিটির অসংসদীয় আচরণে তোপ দেগে আরও একবার সংসদীয় পরিসরে একজোট বিরোধী শিবির।
এদিন সকালে পরনে লাল শাড়ি, চোখে কালো সানগ্লাস, কাঁধে তিন-তিনটি ব্যাগ নিয়ে এসে পৌঁছান মহুয়া। সূত্রের খবর, সেসব ব্যাগে রাখা ছিল মহুয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা নথিপত্র। অপেক্ষমান সাংবাদিকদের প্রতি মহুয়া সৌজন্য দেখিয়ে ঢুকে পড়েন৷ বিজেপি সাংসদ তথা কমিটি চেয়ারম্যান বিনোদ কুমার সোনকারের উপস্থিতিতে এরপর দীর্ঘক্ষণ চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। মাঝখানে নেওয়া হয় মধ্যাহ্নভোজের বিরতিও। তার আগে মহুয়াকে একদফা প্রশ্ন দাগেন কমিটি সভাপতি বিনোদ সোনকার,৷ মধ্যাহ্নভোজের পর শুরু হয় দ্বিতীয় দফা ‘ক্রশ এগজামিন’। ঠিক এই পর্বে উত্তাল হয় কমিটির বৈঠক৷ হঠাৎই চিৎকার শুরু হয় কমিটি রুমে। আচমকা দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসেন মহুয়া মৈত্র। পিছন পিছন দানিশ আলি, গিরিধারী যাদব, উত্তম রেড্ডিরা।
মহুয়া মৈত্র সহ বিরোধী দলীয় প্রতিনিধিদের এ দিনের ওয়াকআউট কেন্দ্র করে উত্তাল হয় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিসর। এই ঘটনার পরেই দিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘আজ যা ঘটল তা সংসদীয় ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। ইচ্ছা করে নিজের উপর আসা অভিযোগ খন্ডন করতে না পেরে এথিক্স কমিটির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে ওয়াকআউটের মাধ্যমে আসল ঘটনা থেকে সবার নজর সরাতে চাইলেন মহুয়া মৈত্র৷’ নিশিকান্তের দাবি, ‘২জি ঘোটালার সময়ে একইভাবে বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা ডক্টর মুরলী মনোহর জোশির পিএসি কমিটিকে অপমান করেছিল কংগ্রেস ও তার শরিকি দলগুলি। সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হল আজ।’ এরপর সরাসরি জাতপাতের দোহাই দিয়ে নিশিকান্ত বলেন, ‘এই কমিটির সভাপতি এক অনুন্নতশ্রেণীর মানুষ (বিনোদ সোনকার), তা-ই তাঁকে ও তাঁর এথিক্স কমিটিকে এভাবে অপমানিত হতে হল। মহুয়া মৈত্র অভিযুক্ত, তাঁর বিরুদ্ধে সব প্রমাণ দিয়েছি আমি, স্পিকারকে চিঠি লেখার জন্য আমারই বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে মানহানির মামলা, তবুও এত কিছু করেও নিস্তার পাবেন না মহুয়া৷ সত্যের জয় হবেই।’
বিজেপি সাংসদ তথা কমিটি চেয়ারম্যান বিনোদ কুমার সোনকারের দাবি, ‘কোনও রকম অমর্যাদাকর প্রশ্ন করা হয়নি মহুয়াকে। তাঁর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের প্রেক্ষিতেই প্রশ্নোত্তর চলে৷ তিনি তার মুখোমুখি হতে না চেয়ে কমিটির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন।’ সোনকারের বক্তব্য, কমিটির তদন্তের উদ্দেশ্য ছিল, মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে যে অনৈতিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা। তাই এদিন তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু, তিনি আচমকাই অত্যন্ত রেগে গিয়ে, কমিটির চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে অপশব্দের ব্যবহার করে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি এও বলেন, ‘কমিটির উপর অযথা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আসলে মহুয়া শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানি সম্পর্কিত কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছিলেন না। সেই প্রশ্নগুলি থেকে বাঁচার জন্যই ওয়াকআউট করেছেন।’ অন্যদিকে বসপা সাংসদ দানিশ আলি বলেন, ‘একজন মহিলা সাংসদকে অপমান করা হয়েছে। তাঁকে অত্যন্ত আপত্তিকর প্রশ্ন করেছেন এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান।’ নীতি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে এমন অনৈতিক প্রশ্ন করলেন কি করে? একজন মহিলা সাংসদকে এ ধরণের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার অর্থ কী? তবে দিনের শেষে মহুয়ার সূত্রে ধরে যে ফের একজোট বিরোধী শিবির তা বলাই বাহুল্য।
জানা গিয়েছে, বিরোধী শিবিরের তরফে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং বিজেপি সাংসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হবে৷ এ বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া না এলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক বর্ষীয়ান সাংসদ জানান, ‘ফৌজদারি মামলার তদন্ত করার এক্তিয়ার নেই এথিক্স কমিটির। তা সত্ত্বেও যদি কোনও মহিলার সম্ভ্রম বা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, অভিযুক্ত হন বা না হন, অন্যায় করেছে কমিটি। এই বিষয়ে দ্বিমত নেই।’ দেখার বিষয় এ নিয়ে পরবর্তী কি পদক্ষেপ নেয় এথিক্স কমিটি৷