শুভঙ্কর চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার: কলেজ হল্টে চায়ের আড্ডা তখন তুঙ্গে। প্রচার সেরে চায়ে চুমুক দিতে হাজির হয়েছেন জেলা তৃণমূলের এক নেতাও। ভরসন্ধ্যায় ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলেন আরেক তৃণমূল (TMC) নেতা। ‘সহকর্মী’কে দেখেই গাড়ির কাচ নামিয়ে বললেন, ‘কী রে, তোর নাম আছে তো তালিকায়? চার্টার্ড ফ্লাইটে উঠবি, একটা কোট বানিয়ে নে। পরে সময় পাবি না কিন্তু।’
কথা শেষ হতেই দুজনের হাসি। মিনিটখানেক বাদে কাচ উঠিয়ে নেতার গাড়ি রওনা হল। অন্য নেতাও কোনও এক সভায় ভাষণ দিতে ছুটলেন। চার্টার্ড ফ্লাইটের রহস্যটা কী? চুপিচুপি পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে এক তৃণমূল কর্মী বললেন, ‘আরে শোনেননি, প্রকাশ চিকবড়াইক সব নেতাকে বলেছেন জয় নিশ্চিত। তাই শপথগ্রহণের দিন সবাইকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমান ভাড়া করবেন। সেটাই এখন সবার হাসির খোরাক হয়েছে।’
এবার চারশো পার। ভোটের আগেই এই স্লোগানে দেশ কাঁপাচ্ছে বিজেপি। এটা ভোট প্রচারের একটা কৌশল হতেই পারে। কিন্তু আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশের আত্মবিশ্বাস নিয়ে দলের জেলা নেতারাই চায়ের দোকানে হাসাহাসি ও বিদ্রুপ করছেন। তা থেকেই আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের অবস্থান খানিকটা অনুমান করাই যেতে পারে।
আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র আসলে তিন জেলার সংমিশ্রণে তৈরি। এরমধ্যে আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) কুমারগ্রাম, কালচিনি, মাদারিহাট, ফালাকাটা ও আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের তুফানগঞ্জ এবং জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা বিধানসভা রয়েছে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে হেসেখেলে জিতেছেন বিজেপির জন বারলা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু পাঁচ বছর পায়ের উপর পা তুলে ছিলেন। নিজের আখের গোছানো ছাড়া কার্যত কোনও কাজই করেননি তিনি। বারলার ভূমিকায় এই আসনে ইতিমধ্যেই হলুদ কার্ড দেখেছে বিজেপি। অন্যদিকে, সঠিক সময়ে মাঠে নেমেছে তৃণমূল। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে চা বাগানের শ্রমিকদের পাট্টা এবং বাড়ি তৈরির জন্য লক্ষাধিক টাকা দেওয়ায় বাগানে বাগানে ঘাসফুলের জমি উর্বর হয়েছে। আর রয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ফলে মহিলা ভোটারদের মধ্যে মমতার প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে।
সেই অঙ্কেই আইপ্যাকের কর্মীরা কোন এলাকায় কবে জয়ের মিষ্টি বিলোনো হবে, কবে সবুজ আবির খেলা হবে তার তালিকা বানাতে শুরু করেছেন। আর এইসব দেখেশুনেই হয়তো প্রকাশ আরও একধাপ এগিয়ে বিমান ভাড়ার খোঁজখবর নিয়ে রাখছেন।
তবে রাজনীতির অঙ্ক এত সহজ নয়। আর দু’দিন আইপ্যাকের টিউশন ক্লাসে গিয়েই ওভার কনফিডেন্ট প্রকাশ তৃণমূলের ফাঁকফোকরে গোঁজামিল দিয়ে নিজেই নিজের কাছে সাবাসি নিতে চাইছেন। ভুলের শুরু সেখান থেকেই।
আলিপুরদুয়ারে মূল লড়াই বিজেপি এবং তৃণমূলের। তবে এবার আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভোট নিয়ে ভাবতে হবে দুই পক্ষকেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৭,৪২৭ ভোট। এবারে কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি। জেলা কংগ্রেসের একাংশ চেয়েছিল দল প্রার্থী দিক। কিন্তু হাইকমান্ড সেই দাবি নামঞ্জুর করে বাম প্রার্থী মিলি ওরাওঁকে সমর্থনের হুইপ জারি করেছে। কংগ্রেসের সিংহভাগ ভোট যে বেলচা-কোদাল প্রতীকে পড়বে না, সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। পরিস্থিতি বলছে, শহরকেন্দ্রিক কংগ্রেসিদের কিছু ভোট তৃণমূল পাবে। বাকিটা বিজেপির বাক্সে পড়বে।
চন্দন কাঠ পাচারে অভিযুক্ত, বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা পাশাং লামা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর পাশাং বদলা নেওয়ার কথা শুনিয়েছিলেন। এই নির্বাচন পাশাংয়ের কাছে মোক্ষম সুযোগ তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলার। সেই সুযোগ নষ্ট করতে নারাজ পাশাং ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমেছেন। ফলে কংগ্রেসের ভোট ছাড়াও চা বলয় ও নেপালি অধ্যুষিত এলাকায় পাশাংদের ভোট যে বিজেপির দিকেই ঝুঁকে, তা মোটামুটি স্পষ্ট।
অমরনাথ ঝা, রাজেশ লাকড়া এবং লুইস কুজুর- দলত্যাগী তিন তৃণমূল নেতাও ঘাসফুলের বাগান তছনছ করার জন্য বদ্ধপরিকর। চা বলয়ের আদিবাসী এবং হিন্দিভাষী মহলে তিন নেতারই কমবেশি প্রভাব আছে। অমরনাথ এবং লুইস বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা পদ্মবাগানের পরিচর্যা করবেনই। রাজেশ তলায় তলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।
বিজেপির টোপ গিলে জন বারলা নতুন করে ফন্দি আঁটার জায়গাতে আর নেই। নরমে-গরমে দিল্লির নেতারা জনকে সমঝে দিয়েছেন। তিনি যদি বেগরবাই করেন এবং কেন্দ্রে বিজেপির সরকার গঠিত হয় তাহলে তাঁর কপালে যে দুঃখ আছে সেটা জন ভালোই বুঝতে পেরেছেন। তাই আপাতত ঢোঁক গিলে নেওয়া ছাড়া তাঁর কাছে উপায় ছিল না। যদিও জনের সমর্থকদের সব ভোট যে তিনি পাবেন না সেটা মনোজ টিগ্গাও (Manoj Tigga) ভালো জানেন। তবে জনের তৃণমূলে যাওয়া ঠেকাতে পারাকে বিজেপির সাফল্য হিসাবে চিহ্নিত করা যেতেই পারে।
জনের নিষ্ক্রিয়তা তৃণমূলের হাতিয়ার হয়েছে সেটা ঠিক। রাজ্য সরকার অনেক কাজ করেছে সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি সবুজ পার্টির নেতারা। কারণ, প্রতিদিন টিভিতে এবং সামাজিক মাধ্যমে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এত খবর মানুষ দেখছেন তার বড় প্রভাব পড়েছে তাঁদের মনে। তৃণমূল মানেই দুর্নীতি- এই কথাটা সহজেই বিরোধীরা ভোটারদের বোঝাতে পারছেন।
চোখের সামনে তৃণমূলের স্থানীয় ও জেলা নেতাদের ফুলেফেঁপে ওঠা সম্পদ ভোটারদের চোখ এড়ায়নি। ক’দিন আগেই মাদারিহাটের যে তৃণমূল নেতাকে পাশে দাঁড়িয়ে চা পাতা তুলতে দেখেছেন শ্রমিকরা সেই নেতার গাড়ি, বাড়ি, লাটবাহাদুরের মতো চালচলন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তৃণমূলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ফলে হাজারো সাফাই দিয়েও ভোটারদের বিশ্বাস ও সহানুভূতি আদায় করতে পারেননি মমতার দলের সৈনিকরা।
ঘাসফুলের প্রার্থী নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে মানুষের মধ্যে। ক’দিন আগেই যাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো হল তিনিই কেন লোকসভার প্রার্থী সেই প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই। ইদানীং প্রকাশের বড়লোকি চালচলন, দামি গাড়ি ব্যবহার, আচরণে পরিবর্তনের পর বহু মানুষ বলছেন প্রকাশ আর আগের মতো নেই। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গার ব্যবহার, আচরণ, কথাবার্তা সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করছে। দল পছন্দ না করলেও মনোজকে দেখে রাজনীতি নিরপেক্ষ বহু মানুষ বিজেপিকে ভোট দেবেন।
মমতা, অভিষেকের ঘনঘন সভার পরও আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের ঘরের কাজিয়া মেটেনি। অনেক নেতাই জলে নামলেও বেণি ভেজাতে চাইছেন না। এটা ‘দিল্লির ভোট’। জলপাইগুড়ির মতো আলিপুরদুয়ারেও আরএসএসের কৌশলী প্রচার কাজে লেগেছে। চা বলয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে না পারায় তৃণমূলকে অনেক বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। যেসব প্রকল্পের কথা বলে ভোট চাইছে তৃণমূল, সেগুলি আদতে কেন্দ্রের প্রকল্প। দিল্লির টাকায় বাহাদুরি করছে রাজ্যের শাসকদল। ব্যাপকভাবে এই কথাটি প্রচার করেছে বিজেপি। তাতে তৃণমূলের সাফল্যকে খানিক খাটো করতে পেরেছে তারা।
সিপিএমের সব ভোট আরএসপিতে গেলে আলিপুরদুয়ারে এবার বামেদের ভোট খানিক বাড়বে। নতুন প্রজন্ম এবং শিক্ষিত ভোটারদের একটা অংশ চাওয়াপাওয়ার অঙ্কের বাইরে গিয়ে বাম প্রার্থীকে সমর্থন করবেন। তবে দাগ কাটার মতো অবস্থায় নেই তারা।
সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানিতে না গিয়ে এটা বলা যায় আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে এবার মাটি কামড়ে লড়াই করছে বিজেপি, তৃণমূল দু’পক্ষই। গত নির্বাচনের চাইতে তৃণমূলের ভোট যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও ভোটের তিনদিন আগে পরিস্থিতির বিচারে এই কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।