সানি সরকার ও অমিতকুমার রায়, শিলিগুড়ি ও হলদিবাড়ি: বন্ধনটা দৃঢ় হয়েছিল মিতালি এক্সপ্রেসের চাকায়। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেলপথে বাংলাদেশের নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এনজেপি ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবিরত রেলযাত্রায়। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া না থাকলেও ‘খোঁচা’ থেকে গিয়েছিল মাঝপথে স্টপেজ না থাকায়। এক বছর পূর্তিতে সেই বাধা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ। শুল্ক দপ্তর, অভিবাসনকেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি চিলাহাটি স্টেশনকে নতুন রূপ দিয়েছে ঢাকা। ৪ জুন নতুন রূপের চিলাহাটির উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পরিকাঠামোর দিক থেকে এখনও পিছিয়ে ভারতের হলদিবাড়ি। এক বছর পূর্তি হলেও প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য হলদিবাড়ির। তাই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের বর্ষপূর্তিতেও মন ভালো নেই হলদিবাড়ি তথা মেখলিগঞ্জের।
হলদিবাড়ির স্টেশনমাস্টার সত্যজিৎ তিওয়ারি মনে করছেন, ‘ইতিমধ্যে ট্রেনটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রতিবেশী দুই দেশ ছাড়াও অন্য দেশের পর্যটকরা। এই ট্রেনে যাতায়াত করছেন।’ হলদিবাড়ি স্টেশনের সুপারিনটেন্ডেন্ট রাম কুমার বলছেন, ‘ইতিমধ্যে ট্রেনটির মাধ্যমে পর্যটন ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি সহায়ক হচ্ছে। স্টেশনে স্টপেজের বিষয়টি মন্ত্রকের নজরে রয়েছে।’
মিতালি এক্সপ্রেসের চাকা গড়ানোর বর্ষপূর্তি হযে গেল বৃহস্পতিবার। গত বছর ১ জুন দিল্লি থেকে ভার্চুযালি দুই দেশের রেলমন্ত্রী ভারতের অশ্বিনী বৈষ্ণো এবং বাংলাদেশের নুরুল ইসলাম সুজন ট্রেনটিকে সবুজ পতাকা দেখিয়েছিলেন। প্রথমবার এনজেপি থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রীবাহি মিতালি এক্সপ্রেস ছুটেছিল। ট্রেনটির সৌজন্যে গতি পেয়েছে দুই দেশের পর্যটন, আরও দৃঢ় হয়েছে আত্মীয়তার বন্ধন। তাই সপ্তাহে দু’দিন নয়, দিনের সংখ্যা বাড়ানো হোক, দাবি উঠেছে দু’পার থেকেই। একইসঙ্গে যাত্রী পরিষেবার স্বার্থে মাঝপথে স্টপেজের দাবিও জোরালো হয়েছে। এই দাবিকেই মান্যতা দিল শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশের অংশে অন্তত চিলাহাটিতে মিতালি এক্সপ্রেসের স্টপেজের জন্য স্টেশনের পরিকাঠামো উন্নযনে নজর দিয়েছে ঢাকা। চিলাহাটিতে গড়ে তোলা হয়েছে শুল্ক দপ্তরের কার্যালয় ও অভিবাসকেন্দ্র। একইসঙ্গে আমূল সংস্কার হয়েছে চিলাহাটি স্টেশনের। ৪ জুন রেলমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। উদ্বোধনের পর থেকে চিলাহাটিতে স্টপেজ পাবে মিতালি এক্সপ্রেস। এ ব্যাপারে ভারতের রেলমন্ত্রকের থেকে অনুমতিও নিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ রেলমন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিক সিরাজদৌলা খান বলেন, ‘সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন চিলাহাটি স্টেশনের উদ্বোধনের পর এখানে মিতালি এক্সপ্রেস দাঁড়াবে। ফলে রাজশাহি ও রংপুরের বাসিন্দাদের ভারতে যাতায়াতের জন্য আর ঢাকায় আসতে হবে না। আবার উত্তরবঙ্গের মানুষ ইচ্ছে করলে চিলাহাটিতে নেমে কাছেপিঠে এলাকায় চলে যেতে পারবেন। অর্থ এবং সময়, দুটোই বাঁচবে।’ বাংলাদেশের ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়ন মতিযার রহমান বলেন, চিলাহাটিতে ট্রেনটির স্টপেজ না থাকায় আমরা হতবাক ও আশাহত ছিলাম। চিলাহাটির বাসিন্দা মকসেদুল হকের বক্তব্য, চিলাহাটিতে স্টপেজ না থাকায় চ্যাংরাবান্ধা বা ফুলবাড়ি চেকপোস্ট হযে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এবার সময় ও খরচ দুটোই বাঁচবে।
উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগে স্থাপনে ১৮৭৮ সালে গড়ে ওঠে হলদিবাড়ি স্টেশন। সেসময় চিলাহাটি হয়ে শিয়ালদা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করত। ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রুটটি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে এই রুটে ট্রেন চলবে, প্রায় ছয় দশক ধরে আশায় দিন গুনতে থাকে দুই পাড়ের বাসিন্দারা। সেই স্বপ্নপূরণ হয় গত বছরের ১ জুন। কিন্তু চিলাহাটি এবং হলদিবাড়িতে স্টপেজ না থাকায় আশাহত হন ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকরা। স্টপেজের দাবিতে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষ। অনেকদিন ধরে হলদিবাড়ি পাসপোর্ট হোল্ডার নাগরিক সমিতি আপ ও ডাউন মিতালি এক্সপ্রেস ঘিরে হলদিবাড়ি স্টেশনে প্ল্যাকার্ড ও ফ্লেক্স সহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিষযটি নজরে আনা হয় রেলকর্তাদের।
হলদিবাড়ি পাসপোর্ট হোল্ডার নাগরিক সমিতির সম্পাদক সামসের আলি সরকার বলেন, হলদিবাড়ি ও চিলাহাটি স্টেশনে মিতালি এক্সপ্রেসের স্টপেজ চালু হলে মেখলিগঞ্জ মহকুমার পাশাপাশি চিলাহাটি, বগুড়া, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর সহ বাংলাদেশ ও উত্তরবঙ্গের প্রচুর মানুষ উপকৃত হবেন। হলদিবাড়ির বরিষ্ঠ রেলকর্মী সত্যরঞ্জন রক্ষিত বলেন, স্টেশনের উন্নতির জন্য হলদিবাড়ি স্টেশনের প্রায় দেড় শতাব্দীর প্রাচীন ভবনটি ভাঙা হয়েছিল। মিতালির স্টপেজের আশায় সেই ক্ষত ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিরাশ করল রেলমন্ত্রক। বর্ষপূর্তিতে আমরা চাই, দ্রুত হলদিবাড়িতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু করে মিতালির স্টপেজ দেওয়া হোক। হলদিবাড়ির স্টেশন মাস্টার সত্যজিৎ তিওযারির বক্তব্য, ইতিমধ্যে ট্রেনটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রতিবেশী দুই দেশ ছাড়াও অন্য দেশের পর্যটকরা এই ট্রেনে যাতায়াত করছেন। হলদিবাড়ি স্টেশনের সুপারিনটেন্ডেন্ট রামকুমার বলছেন, ইতিমধ্যে ট্রেনটির মাধ্যমে পর্যটন ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি সহায়ক হচ্ছে। স্টেশনে স্টপেজের বিষয়টি মন্ত্রকের নজরে রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে চিলাহাটিতে ট্রেন থামলে হলদিবাড়িতে কেন থামবে না, আপাতত এই প্রশ্নে সরব উত্তরবঙ্গের ট্রেনযাত্রীরা।