প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আবারও উসকে গেল ‘গদ্দার’ তত্ত্ব। শেষবার ‘গদ্দার’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন সাগরদিঘির দলত্যাগী বাম-কংগ্রেস জোট বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস। এবার ‘গদ্দার’ রূপে পরিচিত মহারাষ্ট্রের দুই হেভিওয়েট নেতা অজিত পাওয়ার এবং প্রফুল প্যাটেল। রবিবার মহারাষ্ট্রে এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ারের হাত ছেড়ে গেরুয়া শিবিরের হাত ধরেন ভাইপো অজিত পাওয়ার এবং পাওয়ারের দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী প্রফুল প্যাটেল। জনপ্রকাশ্যে অজিত-প্রফুলকে সরাসরি কিছু না বললেও, আড়ালে-আবডালে তাঁদের ‘মীরজাফর’ বলতে পিছপা হচ্ছেন না বিরোধী শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অজিত-প্রফুলকে ভুলে আগামী ১৭-১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় দফা বিরোধী বৈঠকের সাফল্যেই মনোনিবেশ করতে উদ্যোগী ঐক্যবদ্ধ মোদি বিরোধী ফ্রন্ট।
রবিবার বড়সড়ো অঘটন ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। শরদ পাওয়ারের আশ্রয় ছেড়ে ‘পদ্ম’ শিবিরে যোগ দিয়েছেন এনসিপির দুই বর্ষীয়ান নেতা অজিত পাওয়ার এবং প্রফুল প্যাটেল। মহা-রাজনীতির এহেন ‘পাওয়ার-ক্রাইসিস’-এর পরে বেশ কিছুটা অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে বিরোধী শিবির। বিরোধী শিবিরের এই অগোছালো ভাব আরও স্পষ্ট হয় যখন জেডিইউ নেতা কে সি ত্যাগী জানান, পূর্ব নির্ধারিত ১৩-১৪ জুলাইয়ের বেঙ্গালুরুর বিরোধী বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। জল্পনা তৈরি হয়, তাহলে কি মহাজোট গড়ার আগেই বিরোধীদের স্বপ্ন ভঙ্গ হল বিজেপির মহারাষ্ট্র চালে? পাওয়ার ক্রাইসিসের প্রভাবে বিরোধী ঐক্য যে ভেঙে খানখান হয়নি, উলটে বিরোধীরা আরও বেশি একজোট হয়েছেন তার প্রমাণ দিতেই সোমবার বিরোধী শিবিরের তরফে জানানো হল, আগামী ১৭-১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে বৈঠকে বসছে বিজেপি বিরোধী দলগুলি।
এদিন সবার আগে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) কে সি বেণুগোপাল টুইটে লেখেন, ‘পাটনা সামিটের সাফল্যের পরে আমরা বেঙ্গালুরুতে বৈঠক বসবো ১৭-১৮ জুলাই। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করার লক্ষ্যে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একইসঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ।’ এরপরেই বেণুগোপালের টুইটকে রিটুইট করে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন লেখেন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা।’ এই মর্মে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের টুইট, ‘মহারাষ্ট্রের এই পালাবদল আদতে বিরোধী ঐক্যকে আরও মজবুত করবে।’
এদিন বিরোধী শিবির সূত্রে জানানো হয়েছে, আগামী ১৭-১৮ জুলাই বিরোধীদের দু’দিনের ‘বেঙ্গালুরু সামিট’-এর নির্ঘণ্ট চূড়ান্ত। পাটনার বৈঠকের সূত্র ধরে নির্ধারিত বেঙ্গালুরুর বিরোধী বৈঠকের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় ঘরোয়া আলোচনায় বসবেন বিরোধী নেতারা। পরদিন ১৮ জুলাই হবে নীতি নির্ধারণী বৈঠক। শেষে করা হবে সম্মিলিত সাংবাদিক সম্মেলন। দলীয় সূত্রের দাবি, পাটনার মতো বেঙ্গালুরুতেও তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। থাকবেন দলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনও। বেঙ্গালুরুর বৈঠকের এজেন্ডা বা আলোচ্যসূচি এখনও তৈরি হয়নি বলে দাবি জানানো হয়েছে বিরোধী শিবির সূত্রে। বেঙ্গালুরুর বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি থাকবে তার আভাস মিলেছে এদিন। আলোচনা হবে মহারাষ্ট্র ইস্যুতেও। বেশ কয়েকটি বিরোধী দল অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে নীতিগত ভাবে সমর্থন দিলেও তৃণমূল কংগ্রেস যে এর বিরোধী এদিন তাও স্পষ্ট করা হয়েছে দলের তরফে। এই প্রসঙ্গেই তৃণমূল শিবিরের অভিযোগ, ‘ইউসিসি বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হল আনরিটেন বা অলিখিত দেওয়ানি বিধি। দল শুধুমাত্র সাংবিধানিক বিধিই মেনে চলবে।’
উল্লেখ্য, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে যখন বিজেপি বিরোধী মহাজোট গঠন করতে উদ্যত হয়েছে সমমনোভাবাপন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, ঠিক তখনই উঠে আসছে একের পর এক প্রতিকূলতা। পাটনার বিরোধী বৈঠকে দিল্লি অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির মতান্তর চরমে ওঠে। সেই বিবাদের রেশ মেলাতে না মেলাতেই এবার এল মহারাষ্ট্রের ‘পাওয়ার ক্রাইসিস’। গোটা ঘটনায় নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে বিরোধী শিবিরকে। এই পরিকল্পনার অন্যতম অঙ্গ হিসেবেই সোমবার বিরোধী শিবিরের তরফে নজিরবিহীন ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে বিজেপিকে৷ মহারাষ্ট্রের মহাঘোটের নেপথ্যে আসল কুশীলব যে বিজেপি সেটা বুঝতে বাকি নেই বিরোধী শিবিরের৷ সেই কারণেই পুরোনো ‘ওয়াশিং মেশিন তত্ত্ব’কে হাতিয়ার করে এদিন সম্মিলিত ভাবে বিজেপিকে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা৷
এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের প্রবীণ সাংসদ জয়রাম রমেশ একটি টুইট করেছেন যেখানে নরেন্দ্র মোদির ছবি সহ ওয়াশিং পাউডার দেখানো হয়েছে। এই মর্মেই জয়রামের অভিযোগ, গতকাল যখন বিজেপির ওয়াশিং মেশিন আবার সক্রিয় হল মুম্বইয়ে তাদের সঙ্গী আইসিই (আয়কর-সিবিআই-ইডি) কে সঙ্গে নিয়ে, তখন মোদি ঘনিষ্ঠরা বিরোধী ঐক্যের অকালমৃত্যু কামনা করতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তারা হতাশ হয়েছে। কারণ বিরোধীরা তাদের অবস্থান ছেড়ে এক ইঞ্চিও নড়েননি। পাটনার পরে বেঙ্গালুরুতে পুরোদমে বসবে দ্বিতীয় বিরোধী বৈঠক।’ পাওয়ার ক্রাইসিসের পরে বিরোধী শিবিরে এখনও যে ফিল গুড আবহাওয়া বিদ্যমান তার দাবি জানিয়ে তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, ‘অল ইজ ওয়েল।’ তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে এই আক্রমণে শামিল হয়েছে আম আদমি পার্টিও। দিল্লি অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব থাকলেও পাওয়ার ক্রাইসিসে বিজেপিকেই নিশানা করেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে দলের তরফে নরেন্দ্র মোদির মুখ সহ গেরুয়া শিবিরের আস্থাভাজন এবং বিভিন্ন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতাদের ছবিও পোস্ট করা হয়েছে, চুটকিতে দুর্নীতির দাগ মোছার কটাক্ষ করে।