- শাক্যসেন মিত্র
ওডিশায় ক্রমশই এক বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছেন নবীন পট্টনায়ক। শুধু রাজ্যের নয়, দেশের প্রেক্ষাপটেও তিনি এক বিস্ময়। লোকসভার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিধানসভাতেও ভোট। প্রশ্ন, বিজেপি কি নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দলের আধিপত্য খর্ব করতে পারবে? সম্ভবত নয়। একাধিক সমীক্ষা বলছে, বিজেডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ফিরছে। ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পট্টনায়কও রেকর্ড ষষ্ঠবারের জন্য ফিরছেন।
রাজ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি আটটি, বিজেডি ১২টি ও কংগ্রেস একটি আসন জিতেছিল। যদিও সেবার টিকিট না পেয়ে অনেক বিজেডি হেভিওয়েট বিজেপিতে নাম লেখান। কিন্তু তাতে ফলের হেরফের হয়নি। গত দুই দশকে ওডিশার সমস্ত ভোটই নবীন পট্টনায়ক বনাম অন্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মানুষ পট্টনায়ককে ভোট দিয়েই চলেছেন কেন? উত্তর সহজ। তাঁর কাজ ও উত্তরাধিকারের জন্যই। প্রতিটি নির্বাচনে নবীন বিজেডির জন্য মাস্টারস্ট্রোক দেন।
২০১৯ সালে তিনি কৃষকদের আয় জীবিকা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কালিয়া প্রকল্প চালু করেন। ফলত, গ্রামীণ ভোটে বিজেডির ঝুলি ভরে। এবারও বিজু-পুত্র গ্রামীণ ওডিশার জন্য ‘বিনামূল্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প’ চালু করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি বিজেডির ভাগ্য বদলে সহায়ক হবে। ওডিশায় বিজেডি সরকার ফের সরকার গড়লে যাঁরা মাসে ১০০ ইউনিট বা তার কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাঁদের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। আর যাঁরা প্রতি মাসে ১৫০ বা তার কম ইউনিট ব্যবহার করেন, তাঁদের জন্য ৫০ ইউনিট ছাড় দেওয়া হবে। এটি এবারের নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু।
ওডিশায় দীর্ঘদিন থাকার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, ওডিশাবাসী ‘মোদির গ্যারান্টি’র চেয়ে পট্টনায়কের ঘোষণায় অনেক বেশি বিশ্বাসী। বিজেপির পুরী লোকসভার প্রার্থী সম্বিত পাত্রের ‘স্লিপ অফ টাং’ ভোটে দলের প্রচণ্ড ক্ষতি করবে। গত ২০ মে রাজ্যে দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন সম্বিত বলেছিলেন, ‘ভগবান জগন্নাথও মোদির ভক্ত’। পরে একে ‘স্লিপ অফ টাং’ বলে তিনি ধামাচাপার চেষ্টা করেন, কিন্তু ততক্ষণে বিজেপির বিশাল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে এই বিবৃতি নির্বাচনে বিজেপিকে জোরালো ধাক্কা দেবে।
পুরীর মন্দির ও প্রভু জগন্নাথ সম্পর্কে ওডিশাবাসী অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই পরিস্থিতিতে ড্যামেজ কন্ট্রোলে বিজেপি সমস্ত শীর্ষ নেতৃত্বকে মাঠে নামিয়েছে। বিজেডির হাত থেকে ওডিশাকে কাড়তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা, দলের সভাপতি জেপি নাড্ডার মতো হেভিওয়েটরা বারবার রাজ্যে যাচ্ছেন। প্রাথমিকভাবে ওডিশায় বিজেডি-বিজেপি জোটের কথা ছিল। আলোচনার শুরুতে অনেকেই গেরুয়া শিবিরকে দোষারোপ করে। তাঁদের কাছে পট্টনায়ক এমন একজন মানুষ যিনি ‘অন্যায় করতে পারেন না’।
বিজেডি থেকে বিজেপিতে যাওয়া বহু হেভিওয়েটের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কটক লোকসভার ছ’বারের সাংসদ ভ্রাতৃহরি মাহতাবের মতো অনেকেই এবার বিজেপির টিকিট পেয়েছেন। বহু দলবদলিয়া বিধায়কের টিকিট পেয়েছেন। এক্ষেত্রেও ভোটাররা তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলছেন। এবার ওডিশাতেও অনেকে ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন। বিজেপিতে গিয়ে ভোটে হেরে এখন বহু প্রাক্তন তৃণমূল নেতা-নেত্রী অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন।
ওডিশা নির্বাচনে এবার অন্যতম মুখ পট্টনায়ক-ঘনিষ্ঠ ভিকে পান্ডিয়ান। অনেকে এই তামিল আইএএস অফিসারকে ভবিষ্যতের মুখ্যমন্ত্রী বলে থাকেন। পান্ডিয়ান পদ ছেড়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। বিজেপি তাঁকে ‘বহিরাগত’ ও ‘পান্ডিয়ানের হাতের পুতুল নবীন’ বলে প্রচার করছে। পান্ডিয়ানের কাছে পট্টনায়কের আশীর্বাদ আর ওডিশাবাসীর ভোট যথেষ্ট। পট্টনায়কই ওডিশাবাসীর কাছে শেষকথা। বিজেপির ‘ওডিয়া গর্ব’-র দাবিও ভোটারদের উপর প্রভাবহীন।
বিজেডিতে পট্টনায়কের পর পান্ডিয়ান না, অন্য কে? তা কেউ জানেন না। তবে, ওডিশায় এখন অবধি ‘নবীন প্রভা’ বিচ্ছুরিত। ওডিশাবাসী পট্টনায়ককেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চায়। এটাই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, ওডিশায় অন্তত এবার ‘মোদির গ্যারান্টি’ নিষ্ক্রিয়।
(লেখক সাংবাদিক। ভুবনেশ্বরের বাসিন্দা)