বর্ধমান: একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকও মাত্র একজন। শুধু পড়ুয়া এক পাল। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলছে পূর্ব বর্ধমানের মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুল। এই নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের হতাশার অন্ত নেই। তবে ’শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ড নিয়ে জেরবার অবস্থার মধ্যে স্কুলটা এখনও যে চলছে সেটাই বড়কথা’ বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই স্কুলটির এমন দুর্দশা সত্ত্বেও কারও কোনও উচ্চবাচ্য নেই। তবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে স্কুলটিতে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামোর উন্নয়নে প্রশাসন ও শিক্ষা দপ্তরের দ্রুত হুঁশ ফিরুক, এমনটাই চাইছেন এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন।
মাধবপুর গ্রামটি পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের জাড়গ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। আর্থিকভাবেও তাঁরা দুর্বল। পূর্বে মাধবপুর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ছিল না কোনও হাইস্কুল বা জুনিয়র হাইস্কুল। লেখাপড়া শেখার জন্য এলাকার ছেলে মেয়েদের হয় ৬ কিলোমিটার দূরে চকদিঘী, নয়তো ৩-৪ কিলোমিটার দূরে হুগলীর দশঘরা হাই স্কুলে যেত হত। আর এই দূরত্বের কারণেই প্রথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পর মাধবপুর, চকগোপাল, শ্রীকৃষ্ণপুর, মণিরামবাটি প্রভৃতি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ছিল। বিষয়টি এলাকার মানুষজনকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে শিক্ষার স্বার্থে মাধবপুরে একটি হাইস্কুল তৈরির দাবি ক্রমশ জোরালো হয়। শেষমেশ ২০১৭ সালে মাধবপুর প্রাথমিক স্কুলের গা ঘেঁষেই ’মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা পায়।
এদিকে স্কুল প্রতিষ্ঠা পেলেও সেটিকে আদৌ শিক্ষা সহায়ক স্কুল বলা যায় কি না তা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এর কারণটাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ারই মতোই। মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুলে গেলে দেখা যাবে, ৪০০ স্কয়ার ফুটের একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষ। টিচার্স রুম, মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী রাখার ঘর, মিড-ডে মিল রান্নার ঘর কিছুই স্কুলটিতে নেই। প্রাথমিক স্কুল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে বলে জুনিয়র হাইস্কুলে আলো জ্বলে, পাখা ঘোরে। স্কুলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই।
চমকের এখানেই শেষ নয়! মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুলে ক্লাস প্রতি পড়ুয়ার সংখ্যাও চমকে দেওয়ার মতো। এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১১ জন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬ জন, সপ্তম শ্রেণিতে ৭ জন আর অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র ২ জন পড়ুয়া রয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে স্কুলের নাম জিজ্ঞাসা করতেই বোঝা গেল এই স্কুলে পড়ে পড়ুয়ারা কেমন শিক্ষা লাভ করছে! স্কুলের নাম বলতে গিয়েও ওই পড়ুয়ারা ঢোঁকের পর ঢোঁক গিলে চলে। তবে শিক্ষা দানের প্রচেষ্টায় কার্পণ্য রাখেননি একমাত্র অতিথি শিক্ষক। তিনি স্কুলের ২৬ জন পড়ুয়াকে একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে বসিয়েই নিত্যদিন পাঠ দান চালিয়ে যাচ্ছেন।
কঠিন দুরাবস্থার মধ্যেই যে মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুলটি চলছে তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন অতিথি শিক্ষক তপন কুমার নন্দী। তিনি বলেন, ’আমার স্কুলে মূলত আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘু এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতি পরিবারের ছেলে মেয়েরাই পড়ে। স্কুলের বড় সমস্যা শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের ঘাটতি। ২০১৭ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর দু’জন অতিথি শিক্ষক নিয়ে স্কুলটি চালু হয়। তারপর ২০১৮ সালে এই স্কুলের জন্য দু’জন স্থায়ী শিক্ষক এবং একজন করণিক স্যাংশন হয়। কিন্তু তাদের কাউকেই এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তারমধ্যে দুই অতিথি শিক্ষকও অবসর নিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় অতিথি শিক্ষক হিসাবে ২০২২ সালে আমাকে নিয়োগ করা হয়। স্কুলের অফিসিয়াল কাজকর্মও আমাকেই সামলাতে হয়।‘
ব্লকের স্কুল পরিদর্শক (এস আই) অনিন্দিতা সাহাকে মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুলে পরিকাঠামো গত ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘টাইম টু টাইম সব রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো আছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে এখনও কিছু জানানো হয়নি। ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগ হলে তবেই এর সমাধান সম্ভব।‘ তবে জামালপুরের বিধায়ক অলক মাঝি বলেন, ’স্কুলটির বিষয়ে আমি জেনেছি। স্কুলটির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ব্যাপারে আমি প্রচেষ্টা শুরু করেছি।‘