সুদেষ্ণা মৈত্র
উত্তরবঙ্গের একটা অংশে, এই গৌড়বঙ্গে শহরের সঙ্গে না-শহর গা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। কে কোথায় শুরু আর কার সীমানা শেষ, সেকথা বুঝতে হলে মাটির কাছাকাছি আসতে হয়। আসতে হয় জলের কাছাকাছি।
মাটি আর নদী এই গৌড়বঙ্গের ভিতপ্রস্তরে লেগে থাকে অনীহায়, অবসন্নতায়। যেন উপকথার রোমন্থনে তাদের এই পুনরাবৃত্তির সুর। মা যখন ঘোড়ায় কিংবা নৌকা চেপে মর্ত্যে আসার ঘোষণা করেন পঞ্জিকার পাতায়, ঠিক তখন থেকে ভাঙনে ভাসতে থাকে বাঙ্গিটোলা, ভতনি, হুকমাটোলা। মহানন্দা বা ফুলহর তো প্রতি বছরই ভয়ংকর হয়ে ওঠে। অন্য বছর টাঙন বা পুনর্ভবাকে এমন ভয়ংকর মেজাজে দেখা যায়নি, এবার সে অন্য রূপে আবির্ভূত।
মালদার এদিকে পুজোর আগের ছবি বরাবরই যন্ত্রণার। গত বছর ঘর তুলে দিন গুনতে শুরু করে নিত্যানন্দ ঘর তলিয়ে যাওয়ার। সবে পসরা সাজিয়ে বসা আক্রম শুনতে পায় নদীর ফুঁসে ওঠার শব্দ। এই মালদায় শরৎকাল যতটা হোর্ডিংয়ে ঢাকা পড়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি ডুবে থাকে বাঁধন না-মানা বৃষ্টির উচ্ছ্বাসে। নদী গ্রামজুড়ে নতুন এক দিশেহারার সকাল শেখায় প্রায় প্রত্যেক বছর। বীরনগর, ভূতনি, খোসবরটোলা, পশ্চিম রতনপুরে গঙ্গার জল বাড়তে থাকে। ফুলহর আর টাঙনের বাঁধ যায় ভেঙে। বস্তার ওপর বস্তা চাপিয়ে কুলদীপদের নদীতে তলিয়ে যাওয়া কেউ আটকাতে পারে না। পাড় ভাঙার শব্দ সারারাত ধরে টুকরো-সংসারকে স্থানান্তরের মন্ত্র শেখাতে থাকে আবু তাহের, শিবু সোরেন, আদুরি মার্ডিদের। মানিকচকের ঈশ্বরটোলায় ঈশ্বরের প্রবেশ ঘটে না আর। দুর্গার গায়ে যখন মাটির প্রলেপের সমাপ্তিটান এসে লাগে, তখনই একলহমায় জমি, ফসল, ঘর গিলে ফেলে জল। পুজোর জামা কেনার আনন্দের ভিতর কেমন ত্রাণের কান্না ছুঁয়ে থাকে সাজ। এই আকাশ, নদী ও মাটির ষড়যন্ত্রের ভিতরেও রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পায় নেতা-নেত্রী। কিছুদিন এপক্ষ ওপক্ষ দোষারোপ শেষে গাড়ি চড়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা। ন্যাংটো শিশু, ছেঁড়া পুঁটলি, চরের পরিবার আর শারদোৎসব, গৌড়বঙ্গকে এই অভ্যেসেই বাঁচার গল্প শোনায়। তাই, মায়ের আসার আনন্দে চারিদিক যখন আলোখেলায় উন্মাদ, ঠিক তখন জলে ভেসে যায় কাশফুল আর ধান একইসঙ্গে। হাত-ধরাধরি করে।
খাদ্য ও উৎসব দুজনের বিদায়কালীন আবহাওয়ায় অসুরদলনীর কাছে হাতজোড় করে বসে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ছাড়া আর কিছু চাইতে ভুলেই যায় ফুলহর, মহানন্দা, টাঙনের জলের কাছাকাছি ঘর ঘর খেলতে চাওযা মানুষ। ত্রাণশিবিরে এখন প্রচুর ভিড়, ঠিক যেমনটা আর কিছুদিন বাদে মণ্ডপে মণ্ডপে দেখা যাবে। শুধু দুই ভিড়ের চাহনিতে ঘটে যায় ফারাক। একজন খোঁজে দেবীর মুখ, অপরজন আশ্রয়। এটা এই অঞ্চলের প্রতিবারের ছবি। নদীর কাছে হেরে যায় মানুষ। এই শরতের মুখেই দুঃখে ঢেকে যায় আনন্দের রেশ। নুতন জামাকাপড়ের আনন্দ তারা উদযাপন করবে কীভাবে?
দশমীর শেষে উমার স্বগৃহে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া গেলেও এইসব ঘরহারানো উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরানোর ভরসা জোগাতে স্বয়ং দেবীও বোধহয় অনিশ্চিত।