- ধ্রুব গুপ্ত
হিমালয় থেকে নেমে আসা নীলবর্ণ সংকোশ নদী বাংলা আর অসমের সীমানার সঙ্গে বারবার লুকোচুরি খেলতে খেলতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। সে নদীর কোনও অংশকে কেউ কখনও ডেকেছে গঙ্গাধর, কেউ ডেকেছে গদাধর। গোয়ালপারিয়া লোকগানের সুরে তার জন্য গান গেয়েছে বারবার।
নদীতীরের শান্ত অরণ্য, জনপদ, শস্যক্ষেত্রের নিভৃত পথে মানুষের চলাচল বড় শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন। সারাদিনের দুটি মাত্র ডিইএমইউ ট্রেনের নিত্যদিনের অলস, বিলম্বিত যাতায়াতের প্রতি তার অভিযোগ নেই। বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জীবন, নিত্যদ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, ভোগ্যপণ্যের অপ্রতুল জোগান, সরকারি এবং বেসরকারি পরিষেবার নিত্য অভাব- কোথাও তার কোনও অভিযোগ নেই।
পুবদিক থেকে এসে মহাশক্তিশালী ব্রহ্মপুত্র ফি বছর তিন-চারবার বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ভুটান পাহাড়ের ভারী বৃষ্টিপাতের প্রভাব সামাল দিতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে প্লাবনে ভাসছে সংকোশ। আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ভিন্নধর্মের সংগ্রামী মানুষ এসে চরে ঘর বাঁধছে। দু’দশক পিছিয়ে গেলেই এই শান্ত উপত্যকাতেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার স্মৃতি উঁকি মারবে, উত্তরের কোকরাঝাড়-চিরাং থেকে উঁকি মারবে বোড়ো জঙ্গি আন্দোলনের স্মৃতি। এসবের তোয়াক্কা না করে ঘরে বাংলা, বাজারে রাজবংশী, অফিসে অহমিয়া ভাষার পারদর্শিতা দেখাতে দেখাতে তার পরিব্যক্তি ঘটে গিয়েছে অনেক।
সে কান পাতলে আশপাশের ২০৭টি জনজাতির মাতৃভাষা শুনতে পায়। জিভ বাড়ালে মেঘালয়ের আনারস, শালমারার তরমুজ, বিলাসীপাড়ার মাকনা চেখে ফেলে। কিন্তু শান্ত পালপাড়া, সেনপাড়া, ঘোষপাড়া, রায়পাড়ার সুপারিবাগানের ছায়ামাখা টিনের চালে ছাওয়া ঘরগুলিতে কখন যে সুউচ্চ বহুতল ফ্ল্যাট আর শপিং মলের রাহুচ্ছায়া গ্রাস করতে শুরু করেছে, তা বুঝতে তার দেরি হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে ঊর্ধ্বমূল্য আর ভেজালের দ্বিমুখী আক্রমণ আর শপিং মলের লোভনীয় বিজ্ঞাপন তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। অতিশীর্ণ রাজপথ, প্লাবনে চির অভ্যস্ত রাজপথের ওপর সংকীর্ণ বাজারের নিত্য দুর্ঘটনা সামলে ভেজালবিধ্বস্ত ভোগ্যপণ্য কিনতে কিনতে তার দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
তার চোখের সামনে ওই একমেবাদ্বিতীয়ম রাজপথেই মহাদুর্গার ১১২টি প্রতিমার শোভাযাত্রা চলে, অতিকায় পঁচিশ হাত মহাকালীর পুজোর জনযাত্রা চলে, অশোকাষ্টমীতে জনজোয়ার নামে, বসন্ত উৎসবের শোভাযাত্রা চলে, বিহুর শোভাযাত্রা চলে। আবার এই শীর্ণ রাজপথে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকে শববাহক গাড়িটি, বানের জলে ডুবে ফুলে ওঠা মৃতদেহ নিয়ে। লাইব্রেরি ধূলিধূসরিত হয়েছে, সাহিত্যসভা ভবন পর্যবসিত হয়েছে অনুষ্ঠানগৃহে, বাড়িতে বাড়িতে সংগীতচর্চার বাদ্যযন্ত্রগুলিও দীর্ঘকালের ব্যবহারে অকেজো। এইসব খণ্ড ক্ষুদ্র প্রলয়ে বাঙালির চোখের পাতাও কাঁপে না। সে কৈবল্যবাদী, সে নিমিত্তমাত্র।
ব্রহ্মপুত্রে সদ্য ধরা পড়া বোয়াল মাছটাও কেন আটশো টাকা প্রতি কিলোগ্রাম হবে, কেন স্থানীয় দেশি মুরগির দাম বাড়বে- সেসব নিয়ে সে আর তর্ক করে না। ইতি পরিভাবয় সর্বম অসারম বিশ্বং ত্যক্ত্বা স্বপ্নবিকারকম- এই অসার সংসারকে স্বপ্নবিকার ভেবে অগ্রাহ্য করো। এ জীবনকে নিশার স্বপন ভেবে যখন সে হাই তুলতে যাবে, তখনই, ঠিক তখনই তার নাকে প্রবেশ করে নতুন কালিজিরা চালের গন্ধ মাখা ভাপা পিঠের ঘ্রাণ। ছ’রকম পিঠে এখানে সারা বছরই পাওয়া যায়। শুধু পিঠে ভাগ করার জন্য কাকে ডাকবে, সেটাই সে বুঝতে পারে না।
(লেখক অসমের ধুবড়ির বাসিন্দা)