Friday, May 17, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়প্রতিবাদের রাজপথে আর নেই নাগরিকরা

প্রতিবাদের রাজপথে আর নেই নাগরিকরা

 

  • অমল সরকার

ক’দিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একজন পুরোনো একটি রশিদের ছবি দিয়ে  ১৯৬৬ সালে চার চাকা গাড়ি এবং পেট্রোলের দাম উল্লেখ করলেন। উৎসাহ পেয়ে কেউ লিখলেন, ১৯৮৫ সালে উত্তরবঙ্গে কর্মরত থাকার সময় পেট্রোল এবং পাঁঠার মাংসের দাম কত ছিল। কেউ উল্লেখ করলেন ১৯৭৪ সালের বাজারদর।

বাকিদের পেশ করা দরদাম থেকে একজন অঙ্ক কষে লিখলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৪-১৯৮৫ এই ১১ বছরে পেট্রোলের দাম মাত্র ৫.৭৫ টাকা বেড়েছিল।’ সেই পোস্টের জবাবে আর একজন লিখলেন, ‘হ্যাঁ, মানে পেট্রোলের দাম ওই দশ বছরে পাঁচ গুণ বেড়েছিল। ২০১৪-২০২৪-এই দশ বছরে নিশ্চয়ই পেট্রোলের দাম পাঁচ গুণ বাড়েনি।’

ফেলে আসা দিনের জিনিসপত্রের দরদাম নিয়ে আলোচনা এক নির্মল আড্ডা। বয়স যত বাড়ে নস্টালজিয়া তত চেপে ধরে। আলোচ্য হোয়াটসঅ্যাপ আলোচনায় রাজনীতি টেনে আনা হল ২০১৪ থেকে ’২৪-এর তুলনা টেনে দিয়ে। গোড়ায়, রাজনীতির এই প্যাঁচটা বোধগম্য হয়নি। পরে খেয়াল হল, ১৯৬৬, ১৯৭৪, ১৯৮৫ মানে কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার।

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে সহ-নাগরিকদের মন বেশ ভালো পড়া যায়। পেট্রোল-ডিজেল আর ক’জন কেনেন! আপনি রান্নার গ্যাসের দাম নিয়ে আলোচনা পারুন, কিছুক্ষণের মধ্যেই কেউ একজন ২০১৪-২০২৪-এর তুলনায় আগের কোনও এক পাঁচ কিংবা দশ বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার তুলে ধরে দাবি করে বসবেন, মোদির জমানা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ নয়।

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তো আছেই, চায়ের দোকান, কফি হাউস, উৎসব-অনুষ্ঠান, এমনকি বন্ধুদের ঘরোয়া আড্ডায় এই মানুষের সক্রিয় উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। চাকরিবাকরি নিয়ে আলোচনায় তাঁরা বেমালুম বলছেন, ‘পড়ালেখা করা মানেই চাকরি করতে হবে, তার কী মানে আছে? চাকরি না পেলে ব্যবসা করা যায়।’ প্রশ্ন হল, ব্যবসার পুঁজি কোথা থেকে আসবে, আর দোকান খুলে বসলেই বা কিনবে কে, যদি ক্রেতা না থাকে। টাকা থাকলে তবে তো ক্রেতা। টাকা কই?

অধিকাংশ সময়ই এই ধরনের আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যায়। কেউ না কেউ থাকেন, যাদের আবার ‘সব ব্যাপারে রাজনীতি’ পছন্দ নয়। যদিও এ রাজ্যের শ্মশানযাত্রায়ও বাঙালি শোক ভুলে রাজনৈতিক বিবাদে মগ্ন থাকে। ভুলে যায় কাছের একটা মানুষ চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।

একটি ইউটিউব ভিডিওতে দেখছিলাম, একদল মহিলা উচ্চস্বরে বলছেন, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম পাঁচ হাজার টাকা হোক, কিংবা পেট্রোলের লিটার হোক পাঁচশো টাকা, মোদিকে আবার চাই। একজন বলছেন, ‘বিজেপির নামে একটা কুকুর এসে দাঁড়ালেও ভোট দেব।’ তারপর বলছেন, ‘মনে করবেন না, আমি অন্ধবিশ্বাসী। আমি একজন ভক্ত।’ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা শুনে একজন বলছেন, ‘এ নিয়ে চিন্তা করার কী আছে। খরচ কমান।’ তারপর জামা তুলে বলেছেন, ‘এই দেখুন খরচ বাঁচাতে আমি গেঞ্জি পরা ছেড়ে দিয়েছি।’ আর সেই বিজেপি নেতার কথা তো অমর হয়ে আছে, যিনি পেট্রোল-ডিজেলের দাম-যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে গাড়ি ছেড়ে সাইকেল চালানোর নিদান দিয়েছেন।

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাজলজ্জা, যুক্তিতর্কের মাথা খেয়ে আমজনতার জীবনযন্ত্রণাকে তুড়ি মেরে বিপরীত সুরে কথা বলতে পারার স্পর্ধাধারী এই নাগরিকরা সংখ্যায় কত, আমি জানি না। মোদি নিশ্চয়ই মনে করছেন সংখ্যাটা যথেষ্ট, গত দশ বছরে যাদের মনোজগতকে তিনি নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে পেরেছেন। তাই তো ‘সবকা সাথ’-এর ডাক দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনি সভা থেকে দেশের আপামর মুসলিম সমাজকে নিশানা করতে পারেন। তাদের অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিয়ে, সন্তান সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাকি ধর্ম-সম্প্রদায়ের মনে ভয় ধরানোর খেলায় মাততে দ্বিধা করেন না। তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলীয় সভাপতির মতো শীর্ষ নেতারা সে কথায় তাল মেলান।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের গোরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ করে দেবে। দলীয় সভাপতির নামে বিবৃতি প্রকাশ করে বিজেপি বলেছে, কংগ্রেস দিল্লির তখতে ফিরে এলে এসসি, এসটি, ওবিসি’দের যা কিছু আছে সব মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। মোদির কিছু কিছু কথা শুনে তো মনে হয়, তিনি শুধু হিন্দুদের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের ১৪ শতাংশ মুসলিমই অনুপ্রবেশকারী।

পেট্রোলের দামের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। অনেকেরই মনে থাকবে, বছর বারো আগে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণেই ভারতে প্রতিবাদের ‘আরব বসন্ত’ সংঘঠিত হয়েছিল। দিল্লির রাজপথে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। মুখ বুজে থাকেনি বলিউড। অমিতাভ বচ্চনের সেই টুইটটির কথা মনে আছে? পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মনমোহন সরকারকে খোঁচা দিয়ে টুইটে বলিউডের শাহানশা উপহাস করেছিলেন-

‘পাম্প অ্যাটেনডেন্ট : কিতনে কা ডালু?

মুম্বইকার : দো চার রুপিয়া কা গাড়ি কে উপর স্প্রে কর দে ভাই, ইসকো জ্বালানা হ্যায়!’

অনুপম খেরের টুইটটি ছিল, ‘আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি দেরি করলে কেন? সে জবাব দিল স্যর, সাইকেল চালিয়ে এসেছি। আমি জানতে চাইলাম, কেন, তোমার মোটর সাইকেলের কী হল? সে উত্তর দিল, স্যর, ওটা এখন বাড়িতে শোপিস হিসেবে রাখা আছে।’

দশ বছরে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, ওষুধপত্র, দুধ-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, হাটবাজারে যাওয়া মানুষমাত্রেই জানেন। অনুপম খের না হয় গেরুয়া শিবিরের মানুষ, কিন্তু অমিতাভ বচ্চন? তিনি নীরব কেন?

প্রধানমন্ত্রী মুসলিমদের আক্রমণ করলে প্রতিবাদ করার দায় শুধু আসাদউদ্দিন ওয়াইসির কেন হবে? গণতন্ত্র বিপন্ন বলে কেন শুধু রাহুল গান্ধি চিৎকার করবেন? চুপ কেন শাবানা আজমি, জাভেদ আখতাররা? এই দম্পতিই তো স্বতঃপ্রণোদিত বিবৃতিতে মুসলিমদের বলেছিলেন, অযোধ্যা মামলার রায় মেনে নিতে। কেন মুখ খুলছে না নাগরিক সংগঠনগুলি। তারা বলতেই পারে, আমরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি না। কিন্তু গণতন্ত্রের সর্বজনীন উদযাপন নির্বাচন কি নাগরিক, নাগরিক সংগঠনকে বাদ দিয়ে!

গত মাসে সুইডেনের সংস্থা ভি-ডেম (ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্র্যাসি) গণতন্ত্রের মানদণ্ডে ১৭৯টি দেশের মধ্যে ভারতকে ১৪০তম স্থানে রেখেছে। সেই সঙ্গে চলতি সময়ে সবচেয়ে খারাপ স্বৈরতন্ত্রের একটি বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, ভারত অর্ধ শতক আগের জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছে। জরুরি অবস্থার মতো স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে ছিল অস্থির পরিস্থিতি। ছিল ইমার্জেন্সি জারির সরকারি বিজ্ঞপ্তি। আজ অঘোষিত জরুরি অবস্থায় দমবন্ধ দেশের।

মোদি যখন দেশকে বিশ্বগুরু করার স্বপ্ন ফেরি করছেন, তখন একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মান নিয়ে সরব। উলটোদিকে, শ্মশানের নীরবতা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলির। মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন রেফারির ভূমিকা ভুলে সরকার ও শাসকদলের গোলকিপারে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্মের নামে ভোট চাওয়ার অভিযোগ খারিজ করে তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এই পরিস্থিতির দায় আমরা নাগরিকরা বিরোধী দলগুলির উপর চাপিয়ে দিতেই পারি। তাতে ভুল নেই। কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্যই বলে দিচ্ছে, ২০২৪-এর নির্বাচনকে টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার সব আয়োজন সম্পূর্ণ।

নির্বাচনের ময়দানে সদা তুচ্ছ জনতা গণদেবতা, ভোটের ভগবান। তাদের ভুল ধরা বারণ। ভগবান ভুল করতে পারেন না। আজ বলার সময় এসেছে, দেশ রক্ষার দায় আছে আমনাগরিকেরও। নিজের হক বুঝে নিতে মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের দরজা খুলবেন কি না সেটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

woman died in Elephant Attack at belakoba

Jalpaiguri | হাতির হামলায় মৃত্যু ঘিরে উত্তপ্ত বেলাকোবা, বন দপ্তরের গাড়ি ভাঙচুর!

0
বেলাকোবা: হাতির হামলায় (Elephant Attack) যুবতীর মৃত্যুতে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠল জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri) জেলার বেলাকোবা (Belakoba) সংলগ্ন বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের নধাবাড়ি এলাকায়। ঘটনাস্থলে বনকর্মী ও...

Kartik Aaryan | মুম্বইয়ে বিলবোর্ড ভেঙে পড়ার ঘটনায় মৃত্যু কার্তিক আরিয়ানের কাকা-কাকিমার, শেষকৃত্যে হাজির...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সোমবার ঝড়ের দাপটে মুম্বইয়ের (Mumbai) ঘাটকোপার এলাকায় ভেঙে পড়ে একটি বিশালাকার বিলবোর্ড। যা কিনা বেআইনি বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং বলে জানা গিয়েছে।...

Paris Olympics | ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে উপরে, তবুও অলিম্পিক্সে রিজার্ভে বাংলার ঐহিকা, বিতর্ক তুঙ্গে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ টেবিল টেনিসের ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারতীয় মহিলা প্যাডলারদের মধ্যে শীর্ষে থেকেও প্যারিস অলিম্পিক্সের মহিলা দলে জায়গা হল না ঐহিকা মুখোপাধ্যায়ের। প্যারিসে...

Indian Student Protest in Canada |  কানাডায় হঠাৎ নিয়ম বদল, বিতারনের মুখে ভারতীয় পড়ুয়ারা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কানাডার (Canada) বুকে প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপে সমস্যার মুখে পড়েছেন ভারতীয় পড়ুয়ারা। তাঁদের অভিযোগ, স্নাতক হওয়ার পরও সেখানে কাজ করার অনুমতি...

Alipurduar | শুকিয়ে গিয়েছে অধিকাংশ নদী-ঝোরা, জলসংকট বক্সার তিন গ্রামে

0
মণীন্দ্রনারায়ণ সিংহ, আলিপুরদুয়ার: পাহাড়ের বুক চিড়ে আসা অধিকাংশ নদী ও ঝোরা শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে আলিপুরদুয়ারে (Alipurduar) বক্সা পাহাড়ের (Buxa Hill) কোলে থাকা তিনটি গ্রামে...

Most Popular