- শুভঙ্কর ঘোষ
খুব সম্প্রতি গাজায় হামাস-ইজরায়েল সংঘর্ষে আহত শিশুদের চিকিৎসা করতে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারের চিকিৎসক নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন ‘ডব্লিউসিএনএসএফ’। উন্ডেড চাইল্ড, নো সারভাইভিং ফ্যামিলি। অর্থাৎ আহত শিশু, পরিজনহীন। তিন বছরের আহমেদ শাবাত তার বাড়িতে ইজরায়েলি বোমার আঘাতে প্রায় ২০ মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। বাবা-মা ও বড় ভাই মারা যান, শুধু ছোট ভাই ওমর শাবাত বেঁচে যায়। ঠিকানা হয় হাসপাতাল। দু’বছরের ছোট্ট শিশু মুনা আলওয়ান চোখ ও চোয়ালে গভীর চোট পায়। হারিয়েছে পরিবারের সকলকে। কেউ কাছে এলে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, কখনও তীব্র আর্তনাদ করছে। হাসপাতালে শুয়ে বারবার মা-মা বলে ডাকছে।
গত বছরের সাত অক্টোবর দশ মাসের কেফির বিবাস এবং তার দাদা বছর চারের আ্যরিয়েল বিবাসের মতো ইজরায়েলি শিশুদের বন্দি করে হামাস যোদ্ধারা।
এখনও এরা বেঁচে কি না কেউ জানে না। এ বছর ১৮ জানুয়ারি কেফিরের এক বছর পূর্তিতে তার মুক্তি দাবি ও বিশ্ববাসীর প্রার্থনাই ছিল একমাত্র আশার আলো। গাজা ভূখণ্ডে হামাস ইজরায়েল যুদ্ধ কতদিন চলবে, কীভাবে শেষ হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনা কোনও সঠিক দিশা নির্দেশ করে না।
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। নাকি খেলাচ্ছলে যুদ্ধ যুদ্ধ তথা মহাযুদ্ধ, শেষমেশ বিশ্বযুদ্ধ। ক্ষমতা দখলের নিত্যনতুন খেলায় পথ যখন উগ্রতায় রঙিন, তখন বিশ্বজুড়ে আতঙ্কবাদী ও উগ্রপন্থীরা অন্তহীন সংঘর্ষে লিপ্ত। এই আবহে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে শিশুরা শিক্ষাহানির প্রত্যক্ষ শিকার। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, অর্থনৈতিক ও লিঙ্গ বৈষম্যের চূড়ান্ত রূপ ফুটে ওঠে এইসব শিশুদের ধূসর জগতে। এমনকি কিছু কিছু তথাকথিত উন্নত দেশেও একই করুণ অবস্থা লক্ষ করা যায়। বঞ্চনা, অত্যাচার ও জীবনহানির কয়েকটি পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক।
গত বছর ১৮ জুন উগান্ডায় একটি স্কুলে হামলা চালায় আইসিস ঘনিষ্ঠ উগ্রপন্থীর দল। ৪১ ছাত্রকে তারা ঠান্ডা মাথায় খুন করে – কনিষ্ঠতমের বয়স মাত্র ১২ বছর। এটি নতুন নয়। এর আগে ১৯৯৮ সালে সন্ত্রাসবাদীরা কেড়ে নিয়েছিল ৮০টি তরতাজা কিশোর-কিশোরীর প্রাণ। ইথিওপিয়ার প্রসঙ্গে আসি। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে আছে ইথিওপিয়া। শ্রেণিসংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে। সমগ্র বিশ্বের পাঁচ বছরের নীচে শিশু সংখ্যার ১৬ শতাংশ বাস করে এই দেশে। ২০২০-’২২ সময়টাতে উত্তর ইথিওপিয়ায় সংঘর্ষ বিরতি সত্ত্বেও টিগ্রে এলাকায় প্রায় ২৩ লক্ষ শিশুর শিক্ষা স্তব্ধ। সোমালিয়া আফ্রিকার আর একটি দেশ যেখানে শিশুদের বিদ্যালয়মুখী না করে সস্তায় শ্রমদান ও সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত করার ঘটনা ঘটে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০১৬ থেকে ২০১৯’এর তথ্য বলছে প্রায় ৬১৪৩ জন শিশুকে জঙ্গিরা নিযুক্ত করেছে তাদের বাহিনীতে। বলপূর্বক বিবাহ ও ধর্ষণের ঘটনাও আকছার ঘটে চলেছে সেদেশে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনও চলছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। সেভ দ্য চিলড্রেন তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৯ লক্ষ ইউক্রেনীয় শিশু কমবেশি যুদ্ধ পরিস্থিতির শিকার। প্রথম দু’বছরে গড়ে প্রতিদিন তিনটি করে শিশুর প্রাণহানি হয়েছে। কমবেশি ৫০০ দিনের ওপর সংঘর্ষে ১৬৪৮ জন নিহত। আহতের সংখ্যা আরও বেশি। মেসোপটেমিয়া সভ্যতা ও সমৃদ্ধির ধারক বাহক ইরাক সাম্প্রতিক অতীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা বাণিজ্যে প্রগতি থমকে আছে দীর্ঘকাল। কিন্তু সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেদেশে শিশুদের। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে আমেরিকা। আট বছর যুদ্ধ লড়ে ২০১১ সালে সাদ্দাম হোসেনের অপসারণের মধ্য দিয়ে আপাতভাবে শেষ হয় সেই যুদ্ধ। ইউনিসেফ তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে প্রায় ৯০০০ শিশুর প্রাণহানি অথবা পঙ্গুত্ব প্রাপ্তির কারণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিপুল সংখ্যক শিশুর অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যহানি যেমন লক্ষিত হচ্ছে, তেমন বিদ্যালয় বিমুখতা ও শিক্ষার সুযোগ নষ্ট ভীষণভাবে প্রকট সেখানে। এর সঙ্গে দোসর শিশু বিবাহ ও যৌন নিপীড়নের নানা ঘটনা। এক সময়ের যুগোস্লাভিয়ায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ অর্থাৎ প্রায় আট বছর যুদ্ধে মেতে উঠে স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা সহ বিভিন্ন প্রদেশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক ১৮০০০ – ২৭০০০ সার্বিয়ান শিশু গ্রিসের পথে মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও প্রায় ৫৮০০ সার্বিক শিশুর প্রাণহানি হয়।
এবার এশিয়ার একটি বিরাট দেশের কথা উঠবেই। সীমান্ত গান্ধির দেশ আফগানিস্তান দশকের পর দশকজুড়ে বহিরাক্রমণ ও গোষ্ঠী সংঘর্ষে বিদীর্ণ। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল জানাচ্ছে, গত দুই দশকে প্রায় ৩৩০০০ শিশু হয় মারা গিয়েছে নতুবা পঙ্গুত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ও আরও দু’-একটি দেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। আমাদের পড়শি দেশ মায়ানমার বা বার্মা মুলুকে সংঘর্ষ কোনও নতুন ঘটনা নয়। কখনও রাষ্ট্রশক্তি দখলে মিলিটারি উত্থান, কখনও গোষ্ঠী সংঘর্ষ। সম্প্রতি ইউনিসেফ একটি ভালো কাজ করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিশুদের একটি বড় অংশ প্রায় তিন লক্ষ ছাত্রছাত্রীরা আশ্রিত দেশেই মায়ানমার শিক্ষাক্রম বা পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষা লাভ করবে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের আবহে আপাতদৃষ্টিতে ভারতের শিশুরা সুরক্ষিত। কিন্তু অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, জম্মু কাশ্মীর সহ নকশাল অধ্যুষিত রাজ্যে জঙ্গি হামলা, গোষ্ঠী সংঘর্ষ ও অন্যান্য আতঙ্কবাদী কর্মকাণ্ডে শিশুদের বাহ্যিক ও মানসিক বিকাশ গতিরুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ একান্ত জরুরি।
কয়েক বছর আগে করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় সতেরো কোটি শিশু প্রত্যক্ষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এই ক্ষতির অভিঘাত বোঝাতে নিউ ইয়র্ক শহরে সম্মিলিত রাষ্ট্রসংঘের সদর কার্যালয়ের সামনে প্রতীকী ১৬৮টি খালি পড়ার ডেস্ক রাখা হয়েছিল। এক একটি ডেস্ক ফাঁকা থাকার অর্থ দশ লক্ষ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত। বিশ্বজুড়ে আজ প্রায় ৪০ কোটি শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ইতিহাসে দুর্ভিক্ষ মহামারি, নানা মারণ রোগের প্রাদুর্ভাব এসব চিরদিন ছিল, আছে আর থাকবে বলেই মনে হয়। তেমন যুদ্ধ সংঘর্ষ ছিল, আছে ও থাকবে। কখনও ঘরে, কখনও বাইরে। কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও পরোক্ষভাবে। কিন্তু নবজাতক সহ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের কাছে কবির কথায়- এই দৃঢ় অঙ্গীকার করতেই হবে, শিশুদের বাসযোগ্য এই পৃথিবীতে শিক্ষার অধিকার থেকে তারা যেন কোনওভাবেই বঞ্চিত না হয়।
(লেখক কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক)