Friday, May 3, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়লক্ষ্মী ঝলমলে, বিবর্ণ সরস্বতী

লক্ষ্মী ঝলমলে, বিবর্ণ সরস্বতী

  • দেবদূত ঘোষঠাকুর 

বিধানসভায় রাজ্য বাজেটের দিন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর এক একটা ঘোষণার পরে জোরে জোরে টেবিল চাপড়াচ্ছিলেন। সব থেকে বাহবা পেল লক্ষ্মীর ভাণ্ডর প্রকল্পে অনুদানের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায়।‌ বলা ভালো লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে হাত উপুড় করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।‌ লাগাতার এই টেবিল চাপড়ানির মধ্যে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম বাজেট বইয়ে।

লক্ষ্মীর তো একটা হিল্লে হল! সরস্বতীর কী খবর? দেখলাম সরস্বতী রয়েছেন সেই তিমিরেই। সরস্বতীকে উৎসাহ দিতে তেমন কিছু চোখে পড়ল না।‌ পড়বেই বা কী করে? বছর ঘুরতে চলল, রাজ্যের কোনও সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্মসমিতির বৈঠকও ডাকা যাচ্ছে না। তার ফলে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিশবাঁও জলে। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। মেধাতালিকায় নাম থাকা স্কুলের চাকরিপ্রার্থী কয়েকশো তরুণ-তরুণী শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রাস্তায় বসে আছেন। আদালতে ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁদের ভবিষ্যৎ।

স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর প্রচুর পদ খালি। নিয়োগ নেই। শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) তৈরি করেছিল। তার মাধ্যমে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হয়ে আসছিল। কিন্তু গত তেরো বছরে একবারও নির্বিঘ্নে সেই পরীক্ষা হয়নি। যে দু’তিনবার নিয়োগ হয়েছে, তাতে অজস্র অভিযোগ উঠেছে। আদালতে কমিশন তথা সরকারকে জেরবার হতে হয়েছে। এসএসসি’র চেয়ারম্যানের মর্যাদাপূর্ণ পদটি কার্যত মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে। কে কবে ওই পদে বসেন আর কবে পদত্যাগ করেন, তার হিসাব রাখাই কঠিন।

গত বছরের অগাস্ট মাস থেকে উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের যে বদলি পদ্ধতি চালু হয়েছে তাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলো থেকে প্রচুর শিক্ষক বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছেন শহর ও শহরতলির স্কুলে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এমনিতেই গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর শূন্যপদের সংখ্যা শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোর তুলনায় অনেকটা বেশি। বিশেষ করে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়গুলো পড়ানোর শিক্ষক বাড়ন্ত। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী যতজন শিক্ষক থাকা দরকার, বাস্তবে তার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক নিয়ে কোনওরকমে দায়সারাভাবে স্কুল চলছে। গ্রামবাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা একদম ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি এসএসসি’র মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির হদিস মিলছে। সরস্বতী তাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন।

প্রতিষ্ঠান পরিচালনার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দলতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ আরও বৃদ্ধি করার জন্য রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালের পরিবর্তে প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটার হবেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়বে বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। রাজ্যের এক শিক্ষাবিদের কথায়, ‘আমরা এখানে সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করছি।’‌

প্রিটোরিয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গিয়ে, তার প্রবেশদ্বারে একটি উক্তি নজরে এসেছিল কয়েক বছর আগে। সেই উক্তিটি এতদিন পরে ব্যবহার করার সুযোগ পেলাম। এটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘কোনও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্রের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ, এইভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা তৈরি দালান, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেউলিয়া হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হল একটি জাতির অবলুপ্তি।’

কতদিন আগে এই উক্তিটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল তা খেয়াল করিনি। তবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা নিয়ে যা চলছে তা দেখলে হয়তো আর একটি বাক্য সংযোজিত হত- ‘যাঁদের হাতে শিক্ষা দেওয়ার ভার তাঁরা যদি মেধার পরিবর্তে অর্থ দিয়ে নিযুক্ত হন, তা হলে সেই জাতির ভবিষ্যৎ অতি ভয়ংকর।’

সম্প্রতি এক প্রাক্তন উপাচার্য ব্যক্তিগত আলোচনায় বলছিলেন,  ‘কয়েক বছর হল,  শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠন বন্ধ। কিন্তু একটার পর একটা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছেই। পড়াশোনার জন্য পড়ুয়াদের স্কুলে আসায় কড়া নির্দেশিকা না থাকলেও, সরকারি প্রকল্পের সফল রূপায়ণের জন্য তাদের স্কুলে আসা বাধ্যতামূলক। পড়ুয়াদের কাছে এখন পড়াশোনার চেয়ে প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। সবুজ সাথী, ঐক্যশ্রী, শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা ভোগের দিকে যত নজর থাকে, ভালো করে পড়াশোনা করার ব্যাপারে তত জোর থাকে না। শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনের এই অবনমন খুব দুশ্চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন ওই প্রাক্তন উপাচার্য।

কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষানীতির সঙ্গে তাল রেখে রাজ্য সরকারও অনলাইন ক্লাসকে উৎসাহ প্রদান করছে। কিন্তু আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারে না। তাছাড়া ক্লাসের ভিতরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শারীরিক উপস্থিতিতে পঠনপাঠন যতটা ফলপ্রসূ হতে পারে, অনলাইনে সেটা সম্ভব নয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত হওয়ার জন্যও তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসা দরকার। অনলাইনের দূরশিক্ষা পড়ুয়াদের পূর্ণ মানুষ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হতে পারে না। ইতিমধ্যেই অনলাইনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তারা পরীক্ষাকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে পরীক্ষায় বসতে অস্বীকার করছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পড়াশোনা না হওয়ার কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো হয়নি বলেই তারা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করতে চাইছে। এ এক ভয়ংকর মানসিকতার উদ্ধত প্রকাশ! এখন স্কুলের টেস্টে ফেল করে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ভর্তির দাবিতে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের আন্দোলন করতেও দেখা যায়। কোথায় গিয়েছে এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা!

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এসব প্রশ্রয় দিয়ে শাসকের লাভটা কী? এক শিক্ষাবিদ সত্যজিৎ  রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটির উদাহরণ দিয়েছেন। পণ্ডিতকে কবজা করাই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কেন? পণ্ডিতকে ধরে আনার পরিকল্পনা হিসেবে রাজা বলছেন, ‘এরা (প্রজারা) যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।’ এর জন্য রাজার পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকে- ‘লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই’। সত্যজিৎ রায় শাসকের যে অভিসন্ধি ফাঁস করেছেন গত শতকের শেষের দিকে, লিও টলস্টয় সেই একই কথা বলেছেন তারও প্রায় ১০০ বছর আগে। টলস্টয় যা লিখেছেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়,  ‘মানুষের অজ্ঞানতার মধ্যেই সরকারের শক্তি নিহিত রয়েছে। সরকার সেটা জানে এবং সেজন্য সরকার সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার বিরোধিতা করে।’

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

জগন্নাথের রাজ্যে ভোটে তামিল মাহাত্ম্য

0
রূপায়ণ ভট্টাচার্য ভিকে পান্ডিয়ান নামে কি কাউকে চেনেন? না চিনলে চিনে রাখুন। জেনে রাখুন। জিকে ক্লাসে কাজে লাগবে। ভবিষ্যতের জন্যও। ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ান ভারতীয় রাজনীতিতে...

0
Elephant Attack | হাতির হানায় মৃত্যু মহিলার চালসা: রীতিমতো বাড়িতে এসে এক প্রৌড়াকে পিসে দিল হাতি। ঘটনাস্থলেই ওই প্রৌরার মৃত্যু হয়। ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো...

Car Accident | গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু সুরেশ রায়নার ভাইয়ের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার সুরেশ রায়নার ভাই। বুধবার হিমাচল প্রদেশের কাঙরা জেলায় ঘটনাটি ঘটেছে। পুলিশ সূত্রে জানা...

Nagrakata | ৪টি ঘোড়াই রুজির অবলম্বন শেখরের

0
শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: ঘোড়ার গাড়ি চললেই জীবনের চাকা ঘোরে শেখর যাদবের। এলাকায় ছোট-বড় অসংখ্য গাড়ি থাকলেও শেখরের ঘোড়ার গাড়ির কদর কিন্তু কম নয়। এক...

Narendra Modi | ‘যোগ্য চাকরিহারাদের আইনি সহায়তার আশ্বাস’, বর্ধমানে বড় ঘোষণা মোদির

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)। শুক্রবার বর্ধমানে (Burdwan) নির্বাচনি জনসভা থেকে বড় ঘোষণা করলেন...

Most Popular