- ঋষি ঘোষ
ওরা নেট-সেট পাশ করে ফেসবুকে স্ক্রিনশট আপলোড করে। আপলোড করে জানান দেয়, আমরাও লড়াইয়ে আছি। বছরে দুটো করে মোট চারটে (পাশের রাজ্যগুলি ধরলে আরও গোটাকতক স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট) নেট-সেট পেরিয়ে যায়। ওদের ছাত্রছাত্রীরাও নেট-সেট পাশ করে। তারাও ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে স্ক্রিনশট আপলোড করে। জানাতে থাকে, সিস্টেম আমাদের সুযোগ দিক না-দিক; আমরা নিজেদের মতো করে তৈরি। আমরা পড়াতে পারি।
ওরা পশ্চিমবঙ্গের নেট-সেট পাশ করে অধ্যাপনা বা গবেষণার অপেক্ষায় বসে থাকা বেকার ছেলেমেয়েরা। পরিসংখ্যান বলে, সার্ভিস কমিশনের ডাক অনিয়মিত হওয়ায় যাদের সংখ্যা বিগত এক দশকে লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে। দশ বছর আগে যেখানে এই পরীক্ষায় পাশের শতাংশ ছিল দশমিকের কোটায়, সেখানে এই বছরে সদ্য ফলাফল বেরোনো সেট পরীক্ষায় পাশ করেছে প্রায় ৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের মতে, এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতি এই পাশের হার বাড়ার একমাত্র কারণ। অধ্যাপনা বা গবেষণার জন্য তারা কতটা ‘ইনফরমেশন’ রাখে, আর কতটা ‘নলেজ’-বিতর্ক ওঠে তা নিয়েও।
পরিসংখ্যান যেটা বলে না, সেটা হল কোভিড পরবর্তী সময়কাল থেকে অনলাইনে এই নেট-সেটের কোচিংই হয়ে উঠেছে এইসব ছেলেমেয়ের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার আশ্রয়। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে গবেষণার স্বপ্ন দেখা ছেলেটি এই দশ বছরে নাম বদলে শহরের সব থেকে নামজাদা জ্যোতিষী হয়ে যায়। অধ্যাপনার স্বপ্ন তিলে-তিলে পুষে রাখা মেয়েটি শঙ্খ আর উলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে ‘ম্যাডাম’ থেকে ‘হোমমেকার’ হওয়ার পথে এক পা-এক পা করে এগোতে থাকে। ওরা সহজ লোভ আর ভুল বোঝার শিকার হয়। শিকার হয় শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির। নেট পাশ করে বেকার বসে থেকেই বা কী হবে? তার থেকে বরং বিএড বা ডিএলএড করে নিলে চাকরির সুযোগ বেশি…অ্যাকাডেমিক অ্যাম্বিশনকে গলা টিপে মেরে তারা অনেকে কেঁচে গণ্ডূষ করে। আর অনেকে সেই অসামান্য প্রোজেক্ট রিপোর্ট লেখা জেদি মেয়েটার মতো মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তির ফর্ম ফিলআপ না করে বাবার প্লাইউডের ব্যবসা বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চোখের দিকে না তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে, ‘স্যর, পড়াশোনা রিসার্চের একদম বাইরে আছি। ভালোই আছি।’
‘আমরা আসলে প্রতিবছর নেট-সেট পাশ করিয়ে নিজেরাই নিজেদের কম্পিটিটর বাড়িয়ে চলেছি’ একটু হেসে বলে ফেলেন এক কোচিংদাদা। তার কাছে পাশ করা জনৈক ছাত্রী তার স্টাডি মেটিরিয়াল চুরি করে নিজেই নেটের কোচিং খুলে বসেছে। পাশাপাশি, গত আট বছরে এমন একটা ব্যাচও যায়নি, যেখানে কেউ না কেউ নেট-সেট ক্র্যাক করেনি-সেই প্রচ্ছন্ন গর্বও ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।
এতটা আত্মপ্রতারণার পরও এই গর্ব! রাষ্ট্র ব্যবস্থার রেভেনিউ কালেকশনের সফল পরীক্ষাগারের গর্ব? হয়তো তাই। ২৫তম পশ্চিমবঙ্গ সেট-এ পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৬১,১৮৫। পরীক্ষা ফি ৩০০-১২০০ টাকা। এই সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। তবু ওরা ফেসবুকে অনলাইন কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন দেয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার শিরোনাম থেকে কোচিংয়ের নাম দেয়-‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’। প্যান্ডোরার বাক্সের তলানিতে সব হারিয়ে যাওয়ার পর আশাটুকুই পড়ে ছিল। একটু স্বপ্নও কি মিশে ছিল না তাতে?
(লেখক মালদার অধ্যাপক)