- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
কলকাতা কোনওদিন লন্ডন হবে না।
ভারতের মানুষের অচ্ছে দিনও আসবে না।
লোকসভা ভোট দিতে যাওয়ার আগে সব মানুষই এসব জেনে গিয়েছে। জেনে গিয়েছে, অনেক কিছু বলতে হয় বলে বলা। ভোটের মঞ্চে এসব বলতে হয়। কালকেই যাঁকে বলেছেন, চোর চোট্টা, আজ তাঁকেই বুকে নিয়ে অক্লেশে বলতে পারেন, ভাই, আয় বুকে আয়। এসব করতে পারলেই আজকের দিনে নেতা হওয়া যায়।
এই যে এতদিন ধরে ভোটপর্ব চলছে, চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, কোনও নেতার কোনও বক্তৃতা আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে কি? পাওয়া খুব কঠিন হবে।
ভোট হয়ে যাওয়ার পরে বিশ্লেষণে বসলে দেখা যাবে, এবারের ভোটে নেতাদের বক্তৃতায় দুটো জিনিস সুপারহিট। এক, অকথ্য গালাগাল। দুই, অপর্যাপ্ত মিথ্যাচার। যে যা পেরেছেন, গালাগাল দিয়ে গিয়েছেন। যে যা পেরেছেন, মিথ্যা বলে গিয়েছেন। আরও একটা জিনিস হল। দলবদলটা একেবারে স্বাভাবিক, সরল, সহজ করে দিল এই নির্বাচন। যেন এটা নিয়ম। যেন এটা এক অফিস থেকে অন্য অফিসে যাচ্ছি অন্য চাকরি করতে। দলবদল করার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থী করে দেওয়া– অর্জুন সিং, তাপস রায় স্টাইলে- এই ব্যাপারটা সব পার্টিই মেনে নিয়েছে।
এসব দৃশ্যমালা কোচবিহার দেখেছে, কোচিন দেখেছে। জলপাইগুড়ি দেখেছে, জলগাঁও দেখেছে। যে যে কথা বলেনি, সেই কথা তাঁর ওপর চেপে বসে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেসব ভাইরাল করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক পার্টি। কিন্তু কোনও বক্তৃতার টুকরো কি নজরে পড়েছে কারও?
সন্দেহ থাকতে পারে না, এই নির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত স্লোগান অবকী বার চারশো পার। অনেকেই জানেন না বা ভুলে গিয়েছেন, ২০১৯ সালেও ঠিক এক স্লোগান তুলেছিল বিজেপি। অবকী বার চারশো কে পার। এবার শুধু ‘কে’ শব্দটি নেই। ঠিক যেভাবে ২০১৪ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে বিজেপি স্লোগান দিয়েছিল অবকী বার মোদি সরকার। দেখা যাচ্ছে, ‘অবকী বার’ কথাটা বিজেপি ম্যানেজমেন্টের পয়মন্ত বেশ।
এই যে ‘চারশো পার’ শব্দবন্ধের মানে কী? একেবারে শুরুর দিকে বলা হচ্ছিল, এই শব্দবন্ধ দিয়ে বিজেপি বলতে চাইছে, তারা একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাবে নিজেদের। মনে আছে, মাঝে সংসদে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে সেদিন গান্ধি টুপি মাথায় দিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। দু’হাত তুলে চারশো পার বলে দক্ষিণ ভারতীয় টানের হিন্দিতে এমন ব্যঙ্গ করছিলেন যে, মোদি-ধনকর থেকে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়েন। ধনকর তো বলেই ফেললেন, এই প্রথম বোধহয় বিরোধী নেতার ভাষণে ট্রেজারি বেঞ্চ এমন হাততালি দিচ্ছে। মোদি পরে নিজস্ব গুলিয়ে দেওয়ার স্টাইলে বলেন, চারশো পার যে বিজেপি করবে, তা খাড়গে পর্যন্ত মেনে নিচ্ছেন।
ঘটনা বলছে, এই চারশো পারের মানে বিজেপি কিন্তু ঘনঘন পালটাচ্ছে। ১৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল, মোদির ৬০টি ভাষণ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল। মোদি এই চারশোর বেশি সংখ্যাটাকে অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। বলছেন, বিজেপির এই চারশো প্লাস দরকার এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের স্বার্থে। নইলে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে সংরক্ষণের সুবিধে দিয়ে দেবে মুসলিমদের।
এভাবে চারশোর ব্যাখ্যাটা পালটে গেল কেন? কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোট প্রথম দিকে রব তুলেছিল, মোদি-শা চারশো পারের কথা তুলেছে একটা কারণেই। বিশাল সংখ্যার আসন এনে বিজেপি সংবিধান পালটে দেবে। এজন্যই এত চিৎকার। বিজেপি কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে অর্থটা পালটে দেওয়ার চেষ্টায়।
দেশের ইতিহাসে ভোটের আগে অনেক ধরনের স্লোগান উঠেছে। কখনও সেই স্লোগান কাজে দিয়েছে, কখনও দেয়নি। কংগ্রেস এবং বিজেপি, সবাই সাফল্য ও ব্যর্থতার সঙ্গী। ২০১৪ সালের অচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়, ২০০৪ সালের কংগ্রেস কা হাত, আম আদমি কে সাথ, ২০০৪ সালের ইন্ডিয়া শাইনিং মনে আছে সবারই। এখন যেমন মোদির নামে সব স্লোগান, অতীতে ইন্দিরা-ভিপি-অটলবিহারীকে রেখেও স্লোগান চর্চা দেখেছে ভারত। ১৯৯৬-কে মনে করলে আসবে- বারি বারি সবকি বারি, অবকী বারি অটলবিহারী। ১৯৮৯ মনে করােব মান্ডার রাজাকে– রাজা নহি ফকির হ্যায়, দেশ কি তকদীর হ্যায়। ইন্দিরাকে জড়িয়ে দু’বার ভোট হয়েছে। একবার করেছেন বিরোধীরা, ১৯৭৭ সালে। ইন্দিরা হটাও, দেশ বাঁচাও। কংগ্রেস আবার ১৯৮৪ সালে ক্ষমতায় ফেরে ইন্দিরাকে স্মরণে রেখেই– যব তক সুরজ চাঁদ রহেগা, ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা।
আরও অতীতের দুটো স্লোগান মনে আছে, যা সাড়া ফেলেছিল দেশে এবং তাতে কোনও ব্যক্তি স্লোগান ছিল না। মানুষের কথা ছিল বরং। ১৯৭১ সালে ইন্দিরার গরিবি হটাও এবং ১৯৬৫ সালে লালবাহাদুরের জয় জওয়ান, জয় কিষান।
তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না যে পক্ষে ও বিপক্ষে গাদাগাদা মিম বেরিয়ে যাবে ওই স্লোগান নিয়ে। টিভি ছিল না যে নেতার রণহুংকার দেখে লোকে সেই স্টাইলকে নকল করবে। ভরসা বলতে ছিল রেডিওর খবর এবং আড্ডাঘর। রাজধানী নয়াদিল্লিতে এমন একটা আড্ডাঘর ছিল কনট প্লেসের এমব্যাসি রেস্তোরাঁ। ৭৫ পেরোনো রেস্তোরাঁয় সকালটা সব দলের স্থানীয় রাজনীতিকরা আড্ডা মারতেন। ওই সময় প্রবেশাধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের। তাঁরা ঢুকতে পারতেন দুপুর থেকে। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে আবার বোঝা গেল, পরিস্থিতিটাই পালটে গিয়েছে। এখন নেতারা আর ওদিকে আসেন না। সন্ধে হতেই বিশাল টিভিতে আইপিএল চলে। দেশের ভোট স্লোগান সর্বস্ব হয়ে গেলেও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে কোনও রাজনৈতিক স্লোগান আর ঝড় তোলে না।
যে প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল, সেই প্রশ্নটায় ফিরে যাই। কোনও নেতার ভাষণের একটি লাইন কি যুগান্তকারী মনে হল, যা মনে রেখে দেবে ইতিহাস? দেশজুড়ে ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন মোদি। হাওয়ায় ভাসছে তাঁর ফেরার সম্ভাবনা নিশ্চিতপ্রায়। তিনিও কি নতুন কোনও অমৃতের সন্ধান দিলেন ভাষণে? বরং যত দিন যাচ্ছে, তাঁর ভাষণে প্রকট অস্থিরতা। যা ভেবেছিলেন, ততটা মসৃণ কি নয় পরিস্থিতি? মোদি ঢেউ বলতে যা ছিল গত নির্বাচনে, তা এবার নেই। রাম মন্দিরও সেই আবেগ আনতে পারেনি দেশজুড়ে। যা জেগে আছে, সেটা অবশ্য মোদিকে জেতাতে বড় ভূমিকা নেবে। হিন্দুত্ববাদ।
এই একরকম অস্থিরতা প্রকট মমতার ভাষণেও। এক-একবার এক-একরকম কথায় মোদি-দিদি এক। সম্ভবত মমতাও যা ভেবেছিলেন, ততটা মসৃণ নয় রাজ্যের পরিস্থিতি। মাঝে একটা সময় তৃণমূল মমতাকে দিল্লির গদিতে দেখার কথা ভেবে স্লোগান বানিয়েছিল একটা। এখন সেই স্লোগান মোটামুটি চিলেকোঠায় তুলে রেখে দিয়েছেন নেতারা। আশ্চর্যের ব্যাপার, শিলচরে একটা ভাষণ বাদে রাজ্যের বাইরে কোথাও যাননি মমতা। অথচ ইন্ডিয়া জোটের নামটা তাঁর দেওয়া, এটা বলে বেড়াচ্ছেন তিনি। আসলে যে যাঁর গদি সামলাতে ব্যস্ত।
বাকি রইলেন রাহুল গান্ধি। ভারত জোড়ো যাত্রার ঠিক পরে পরে রাগার যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, তা আবার অনেকটা ম্রিয়মাণ। তাঁর মধ্যেও অস্থিরতা প্রকট। প্রমাণ দেয় একেবারে শেষদিনে, সাতসকালে রায়বেরিলি থেকে প্রার্থী পদ ঘোষণা করার ঘটনাটা। সবাই যেখানে ‘আমেথি’ করছিল, সেখানে রায়বেরিলিতে দাঁড়িয়ে চমকে দিলেন রাগা। গোপন রাখার স্ট্র্যাটেজিতে তিনি সফল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আমেথিতে স্মৃতি ইরানি ছিলেন বলেই কি সেখানে দাঁড়ানোর ভরসা পেলেন না রাজীব-তনয়? তিনিও সম্ভবত মমতার মতো ধরে নিয়েছেন, বিজেপির আসন কমানো যাবে, কিন্তু বিজেপিকে আটকানো যাবে না।
চমকে দেওয়া ভাষণের কোনও লাইন নেই, নিশ্চয়তার মধ্যেও অস্থিরতা রয়েছে সর্বত্র। একেবারে এক ঝলকে নির্বাচনকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এভাবেই করতে হবে।