- রম্যাণী গোস্বামী
শীতসন্ধ্যায় শিলিগুড়ির পাড়ায় পাড়ায় নবারুণ সংঘ, সংঘশ্রী ক্লাবের চিলতে মাঠগুলো সচকিত হয়ে ওঠে সমবেত ‘খিয়া খিয়া’ ধ্বনিতে। কাছে গেলে দেখা যায় একদল কচিকাঁচা ও কিশোর-কিশোরী সফেদ ঢিলেঢালা পোশাকে (যার প্রচলিত নাম ‘গি’) ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই ছন্দে হাত-পা শূন্যে ছুড়ছে। ওদের শরীরে জন্মানো বিন্দু বিন্দু ঘামের চিকচিক মাঠ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকদের মুখে এনে দিচ্ছে গভীর আত্মপ্রসাদের হাসি।
শিক্ষা শুরুর কিছুদিন পর থেকেই আরম্ভ হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের টুর্নামেন্টে ছোটা। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি থেকে ফালাকাটা-কোচবিহার, হাওড়া-বর্ধমান অথবা রাজ্যের বাইরে কর্ণাটক-দিল্লি। গোল্ড, সিলভার – ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল মেডেলগুলো ঝকঝক করে প্রত্যয়ী কিশোর-কিশোরীদের গলায়। ধীরে ধীরে কোমরের কাছের ওই বেল্টও রং বদলায় শিক্ষার্থীর নিপুণতা বা দক্ষতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। সাদা, কমলা, নীল, সবুজ, পার্পল, খয়েরি। আর অবশেষে ব্ল্যাক বেল্ট।
খেলা সম্পর্কে যাঁদের ধ্যানধারণা আছে, তিনটি প্রশ্ন প্রবল রয়েছে। এক, এই ধরনের টুর্নামেন্টগুলো কতটা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক? এখানে অনেক টুর্নামেন্টেই রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে যেতে হয় নিজেদের টাকা খরচ করে। এটা কোনও খেলায় হয় না। ক্যারাটেতে হয় কেন? দুই, টুর্নামেন্টগুলো কতটা বৈধ বা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। এই মেডেলগুলোই বা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? তিন, ক্যারাটের মধ্যেই অনেক রকম ভাগ রয়েছে। অন্তত ৭৫ রকম। সব কোচই দাবি করেন, তাঁদেরটা আসল। মূলত চারটে ক্যারাটে। শতোকান-রু, শিতো রু, গজু-রু, ওয়াডো-রু। কোনটা ভালো, সেটা নিয়েই প্রশ্ন।
আজ থেকে দু’দশক আগেও শহরতলি আর মফসসলের অলিতে-গলিতে ক্যারাটে বা তাইকোন্ডো শেখার এতখানি প্রবণতা দেখা যেত না ছোটদের মধ্যে। বা বলা ভালো সেই আগ্রহ ছিল না তাদের অভিভাবকদের মনেও। ব্যাঙের ছাতার মতো চারপাশে এত ক্যারাটে, তাইকোন্ডো, সেলফ ডিফেন্স অ্যাকাডেমি খুলেও বসেনি তখন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই ধরনের কঠোর ট্রেনিং ব্যবস্থা সত্যিই কি ছোটদের নির্ভীক ও আপসহীন চরিত্র হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে? ক্যারাটের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছেলে বা মেয়েটির অন্তরে কি তার পরবর্তী জীবনে ঘরে -বাইরে, কর্মক্ষেত্রে ও পারিপার্শ্বিকে নিত্য ঘটে চলা অজস্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে? নাকি শুধুই ‘ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ’, মেডেল-কাপের দ্যুতি বা বিভিন্ন কম্পিটিশনের সার্টিফিকেট অবধিই এর দৌড় ? বছর দুয়েক আগে আমাদের রাজ্যের জাতীয় স্তরের ক্যারাটে খেলোয়াড় চোদ্দো বছর বয়সি এক কিশোরীর ব্ল্যাকমেলজনিত কারণে আত্মঘাতী হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা সামনে এনে দেয় বহু জিজ্ঞাসা। সেলফ ডিফেন্সে ‘এক্সেলেন্ট’ পাওয়া আইটি কর্মী বা এয়ার হোস্টেস মেয়েটি ভিড় রাস্তায় অনাহূত স্পর্শে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন কি না, সেও ভেবে দেখার। ক্যারাটে গোল্ড মেডেলিস্ট গৃহবধূ নীরবে দিনের পর দিন গার্হস্থ্য হিংসা সইছেন না তো ?
না পারলে নেহাতই ‘গা ঘামানো’, ‘ মেদ ঝরানো’, টিপিকাল শৌখিন শরীরচর্চার ক্লাস অথবা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের নানারঙা মেডেলের দেখনদারি ছাড়া একে আর কী বলা যায় ?
(লেখক সাহিত্যিক ও অধ্যাপক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)