- জয়ন্ত সরকার
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব যখন মানবসমাজকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে তখন হঠাৎ-ই গত দশকের শেষভাগে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল করোনা মহামারি। অজানা ওই ভাইরাসের ভয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়ল মানুষ। বিভিন্ন দেশের সরকার ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, জীবন ও জীবিকা যখন প্রবল সংকটে, তখনই একটি বিকল্প উপায় খুঁজে বের করা হল। গৃহ-কার্যালয় বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৬০ মিলিয়ন মানুষ বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ সম্পন্ন করতে থাকলেন। এরপর ধীরে ধীরে মহামারির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হল পৃথিবী। আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে এল সবাই। অথচ ওয়ার্ক ফ্রম হোম পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল নিয়োগকর্তা ও কর্মচারী উভয়ের কাছেই।
এই বিষয়ে ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা থেকে উঠে আসা কিছু তথ্য পেশ করা যাক। বর্তমান বিশ্বে ৮২ শতাংশ কর্মচারী ওয়ার্ক ফ্রম হোম পদ্ধতিতে কাজ করতে পছন্দ করছেন। ৭১ শতাংশ কর্মচারী ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর বিনিময়ে পদোন্নতি অগ্রাহ্য করতেও রাজি আছেন। ৬৩ শতাংশ মহিলা চাকরি বদল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যদি তাঁদের বাড়িতে বসে করার সুযোগ দেওয়া হয়। ৪৪ শতাংশ চাকরিজীবী মানুষ মনে করেন যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফলে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটেছে। পারিবারিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। যাতায়াতের ঝক্কি ও সময় বেঁচে যাওয়ায় তাঁরা ব্যক্তিগত কাজ, শরীরচর্চায় খানিকটা সময় অতিবাহিত করতে পারছেন।
এবার আসা যাক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির কথায়। তাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা অনুসারে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফলে কর্মীদের কর্মক্ষমতা ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাই স্থায়ীভাবে এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে চলেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম দু’রকম মডেলে হতে পারে। রিমোট মডেল, হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেল। রিমোট অর্থাৎ প্রতিদিন বাড়িতে বসে অফিস করা। হাইব্রিড অর্থাৎ সপ্তাহে এক বা দু’দিন অফিস, বাকি দিনগুলিতে বাড়িতে বসে কার্যভার সামলানো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পদ্ধতির ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দিকগুলো কী কী? চাকরিসূত্রে যাঁরা প্রবাসে থাকেন, বৃদ্ধ-অসুস্থ বাবা-মাকে ঠিকমতো সেবা করতে পারেন না কিংবা স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়পরিজন থেকে দূরে থাকায় একাকিত্ব অনুভব করেন, তাঁদের কাছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম একটা আশীর্বাদের মতো। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি সাংসারিক খরচও এর ফলে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। সেই অর্থে এটি একরকম মুক্তির পথ।
অন্যদিকের কথাটা ভাবলে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে হয়। প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন পরিষেবা, বিনোদন জগৎ, বাজারহাট ইত্যাদি সবকিছুই বর্তমানে মানুষের হাতের নাগালে চলে এসেছে। মুঠোফোনের হাত ধরে কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েছি সকলে। কিন্তু কর্মস্থল! সেখানেও যদি সহকর্মী বলে কিছু না থাকে, কাজের ফাঁকে খানিক আড্ডা, ঠাট্টামশকরা করা না যায়, একসঙ্গে যাতায়াত করা, চড়ুইভাতি প্রভৃতি জিনিসগুলো যদি মুছে যায় তাহলে তো বিরাট শূন্যতা নেমে আসবে সামাজিক জীবনে। মানুষ ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে উঠবে।
সুতরাং নিভৃত গৃহকোণ নয়, সহযাত্রী কিংবা সহকর্মীদের নিয়েই গড়ে উঠুক প্রতিটি মানুষের দিনলিপি। রিমোট ওয়ার্ক মডেলের ওই বন্দিজীবন কখনোই নয়, নিদেনপক্ষে হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেলকেই প্রতিটি চাকরিজীবীর অনুসরণ করা উচিত।
(লেখক সাহিত্যিক)