Thursday, May 16, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়উচ্চশিক্ষা নিয়েও ভাবার সময় হল

উচ্চশিক্ষা নিয়েও ভাবার সময় হল

শিক্ষা দুর্নীতির হইচইয়ে বাংলায় উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি চাপা পড়ে গিয়েছে। র‌্যাংকিংয়ে বাংলার প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো নেই।

  • শুভঙ্কর ঘোষ

কে প্রথম, প্রতিযোগিতা এখন আর সীমিত নেই শ্রেণিকক্ষে পড়ুয়াদের মধ্যে। কিংবা টিভিতে সংগীত বা নৃত্যের নিত্যনতুন অবয়বে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি প্রায় নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করছে কখনও আন্তর্জাতিক, কখনও দেশীয় প্রেক্ষাপটে সেরার সেরা তকমা পেতে।

প্রতি বছর এই সময়টা সারা বিশ্বের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাইমসের উচ্চশিক্ষা (টিএইচই) এবং কিউএস র‌্যাংকিং প্রকাশিত হলে সকলের চোখ থাকে কোন প্রতিষ্ঠান কেমন ফল করল। পঠনপাঠনের সকল ক্ষেত্র সম্মিলিত করে প্রথম দশে কারা, প্রথম একশো এমনকি প্রথম পাঁচশোর মধ্যে কারা স্থান পেল তা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত থাকে না। বিভিন্ন বিভাগ বা বিষয় ধরে প্রতিষ্ঠানগুলির শ্রেষ্ঠত্বের চুলচেরা বিচার চলে।

কেমব্রিজ না অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড না এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড না প্রিন্সটন? এইভাবে প্রথম দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ, একশোতে কে কাকে টপকে উপরে চলে এল তা ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবক মহলে অত্যন্ত বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে। ইউরোপ, আমেরিকা, আরব সহ এশিয়াতে সেরার সেরা কে, আগামীদিনে উজ্জ্বল সম্ভাবনায় প্রতিশ্রুত কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শ্রেয় তা অবশ্যই বিবেচ্য পড়ুয়াদের কাছে।

ঘরের কাছেই ছোট দেশ সিঙ্গাপুরের দু’একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এনএসইউ, এনটিইউ চমকে দিচ্ছে কখনো-কখনো বিশ্বের প্রথম দশে ঢুকে যাওয়ায়। পড়শি চিনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন পিকিং, সিনহুয়া প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কখনও প্রথম দশে থাকে। কিন্তু চিন, জাপান, কোরিয়া- এসব দেশের অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিতভাবে প্রথম বিশ, পঞ্চাশ বা একশোতে থাকছে নিয়ম করে। সেখানে ভারতের মতো বিশাল দেশের চিত্র বেশ বিমর্ষজনক, যদিও সম্ভাবনাময় বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক কিউএস র‌্যাংকিং ২০২৪-এ সামগ্রিকভাবে প্রথম একশোতে কোনও ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও বিষয়ভিত্তিক র‌্যাংকিং-এ প্রথম একশোতে জায়গা করে নিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যেমন উন্নয়ন বিদ্যায় জেএনইউয়ের র‌্যাংক ২০, ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনায় আইআইএম আহমেদাবাদের র‌্যাংক ২২। এশিয়াতে অবশ্য চিনের পরেই দাপট ভারতের- অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও সাম্প্রতিক অগ্রগতির নিরিখে।

ব্রিটেনের বিখ্যাত টাইমস পত্রিকা ২০০৪ সালে কোয়াকিউরেল্লি সিমন্ডস (কিউএস) সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির গুণমান বিচার শুরু করে। ২০০৯ পর্যন্ত চলে এই যৌথ উদ্যোগ। এরপর মতপার্থক্য ও অন্যান্য জানা অজানা কারণে দুটি সংস্থা পৃথকভাবে বিশ্ব র‌্যাংকিং প্রকাশ করতে শুরু করে। প্রথম দিকে টাইমস পত্রিকা বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণায় মানক বিচারে পুরোধা থমসন রয়টার্সের সঙ্গে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে গবেষণা পত্রিকা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে টিএইচই বিশ্ব র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়ে আসছে।

অন্যদিকে, কিউএস থেমে থাকেনি এই র‌্যাংকিং প্রকাশ প্রতিযোগিতায়।

পাঠক্রমভিত্তিক এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যেমন পদ্ধতি ও ভালো ফল নিয়ে বিতর্ক স্বাভাবিক, র‌্যাংকিং নিয়ে একই অনুষঙ্গ উঠবে। আমাদের দেশের নিজস্বতা ও অন্যান্য অপরিহার্যতা বিবেচনা করে ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর চালু করে এনআইআরএফ র‌্যাংকিং। ২০১৬ সালে মাত্র চারটি শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠানগুলির গুণমান যাচাই করা হয়- বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট ও ফার্মাসি। বছর বছর আরও বিবর্ধিত হয়ে এখন (গত বছর ২০২৩) তেরোটি শ্রেণিতে র‌্যাংকিং করা হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির। প্রথম থেকেই দাপট দেখাতে শুরু করে আইআইএসসি, বিভিন্ন আইআইটি সহ নামী প্রতিষ্ঠান।

২০২৩ সালের র‌্যাংকিং অনুসারে সামগ্রিকভাবে প্রথম আইআইটি মাদ্রাজ, দ্বিতীয় আইআইএসসি, বেঙ্গালুরু আর তৃতীয় আইআইটি দিল্লি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে জেএনইউ (১০), বিএইচইউ (১১), জামিয়া (১২), যাদবপুর (১৩) এমন কয়েকটি কিছুটা হলেও লড়াইয়ে টিকে থাকে। কিন্তু দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন দিল্লি (২২), কলকাতা (২৩), মাদ্রাজ (৬৫), মুম্বই ( ৯৬) বিশেষ নজর কাড়েনি, দু’একটি বছর ছাড়া। বরং বেশ অবাক লাগে তুলনামূলকভাবে নবীন এবং অপরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত প্রতিষ্ঠান কোয়েম্বাটোরের অমৃত বিশ্ব বিদ্যাপীঠম সামগ্রিক র‌্যাংকিং-এ পনেরো স্থান নিয়ে প্রথম বিশে আছে।

সারা দেশের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক চিত্রে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান এখনও আশাব্যঞ্জক নয়।

এআইএসএইচই তথ্য বলছে, বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভিতর র‌্যাংকিং-এ ২০১০-’১১-র ২৯ অবস্থানের তুলনায় ২০১৮-’১৯-এ ২৭ র‌্যাংকিং-এ পশ্চিমবঙ্গ সামান্য এগিয়েছে। ওই একই সময়ে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৬ থেকে বেড়ে ৪৫ হয়েছে- (অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি) তেমন কলেজের সংখ্যা ৮৫৭ থেকে ১৩৭১ হওয়ায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি সূচিত করেছে। কিন্তু ভীষণ নিরাশ লাগে যখন দেখি সারাদেশে কলেজ থাকার ঘনত্ব ২৮ হলেও আমাদের রাজ্যে সেটি মাত্র তেরো। সর্বভারতীয় গ্রস এনরোলমেন্ট অনুপাত ২৬.৩-এর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এটি ১৯.৩- অর্থাৎ অনেকটাই পিছিয়ে।

সকলেই জানেন নয়াদিল্লির জেএনইউ আর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম বা অতিবাম রাজনৈতিক আবহ বহুদিন ধরে বিরাজমান। সম্প্রতি দেশদ্রোহী বা টুকরে টুকরে গাং খ্যাতি অখ্যাতির মাঝেই জেএনইউয়ের হাল ধরেন উপাচার্য হিসেবে গেরুয়াদের ঘরের আপনজন সংঘসেবক শান্তিশ্রী ধূলিপুরি পণ্ডিত। অবাক কাণ্ড –

জেএনইউ-কে শুধুমাত্র দেশে নয়, বিশ্বমঞ্চে অনেক উঁচুতে তুলে ধরতে সক্ষম হলেন। ঠিক বিপরীত চিত্র যাদবপুরে। উপাচার্য নিয়ে রাজ্য সরকার-রাজ্যপাল সংঘাত শুধু বিচারাধীন নয়, আয়া রাম গয়া রামের মতো অস্থায়ী উপাচার্য খেলা চলছে। সুতরাং সহজেই অনুমেয়, কেন বিশ্ব তথা ভারতীয় র‌্যাংকিং-এ জেএনইউ যেটা করে দেখাচ্ছে সেটা আমাদের যাদবপুর আরও উন্নত ও নিয়মিতভাবে করে দেখাতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলির জন্য একই কথা প্রযোজ্য। আশার আলো একটাই যে স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান যেমন বেলুড়, নরেন্দ্রপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স, রহড়ার মতো কয়েকটি নাম নিয়মিতভাবে সারাদেশের মধ্যে প্রথম দশ বা বিশে নজর কাড়ছে।

সবশেষে একটা কথা বলা দরকার। পাটিগণিত বীজগণিত রাশিবিজ্ঞান সহ অঙ্কের ফর্মুলা দিয়ে যে র‌্যাংকিং হোক না কেন, সাধারণ মানুষের মনে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বিমূর্ত রূপ গড়ে ওঠে একদিনে বা এক বছরে নয়, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়। তখন মনে হয়, কেশব নাগের গণিত বইয়ের তৈলাক্ত দণ্ড বেয়ে বাঁদরের ওঠানামার মতো বিভিন্ন বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির র‌্যাংকিংও বেশ মজার ঘটনা। আবার ভাবি, র‌্যাংকিং যেভাবে ঘরে-বাইরে দুয়ারে এসে পড়ছে তাতে যে কোনও পেশার ক্ষেত্রে এমনকি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাজের মূল্যায়ন শেষে জনসমক্ষে প্রথম দশ, বিশ, পঞ্চাশের তালিকা না প্রকাশিত হয়।

(লেখক কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Mamata Banerjee | কপ্টার নামবে মমতার, মাঠ দিল না মন্ত্রীপুত্রের কলেজ, শোরগোল কাঁথিতে  

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ যেই কলেজের মাথা মন্ত্রীপুত্র, সেই কলেজের মাঠেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টার নামার অনুমতি পেল না। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের অধীন কাঁথিতে দেবাংশু...

Fire arms | ফের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার দিনহাটায়, গত দু’দিনে উদ্ধার তিনটি পিস্তল  

0
দিনহাটা: ফের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার দিনহাটায়। মঙ্গলবার রাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও তাজা কার্তুজ সহ এক দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করলো দিনহাটা থানার পুলিশ।   গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বড়...

Darjeeling | পর্যটকদের জন্য সুখবর! এবার এই নয়া রুটে বাসে করেই পৌঁছে যাবেন দার্জিলিং

0
শিলিগুড়ি: পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের গন্তব্য পাহাড়ি শহর মিরিক। তবে এতদিন মিরিক পর্যন্ত বাস পরিষেবা থাকলেও সেখান থেকে দার্জিলিং যেতে গেলে ভরসা করতে হত প্রাইভেট...

Theft Case | গভীর ঘুমে বাড়ির সদস্যরা, গয়না-টাকা নিয়ে চম্পট দুষ্কৃতীদের

0
হেমতাবাদ: গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাড়ির সদস্যরা। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কার্যত লুঠতরাজ (Theft case) চালাল একদল দুষ্কৃতী। ঘটনার জেরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে হেমতাবাদে। মঙ্গলবার...

Accident | নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দ্রুত গতিতে গাছে ধাক্কা মারুতি ভ্যানের, মৃত ১, আহত ৬...

0
কিশনগঞ্জঃ বুধবার রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে থাকা একটি গাছে ধাক্কা মারল একটি মারুতি গাড়ি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল এক যাত্রীর। গুরুতর আহত হয় আরও...

Most Popular