- কল্যাণময় দাস
চারপাশ খুব স্ক্যারি। যাপনে স্ক্যারি, ঘুমনে স্ক্যারি। সবাই সবার দিকে আড়চোখো। পরিস্থিতি এমন যে, বাবা হাতে টাকা দিয়ে বাজার থেকে ঢ্যাঁড়শ আনতে বললেও মনে খচ করে ওঠে; আমাকে ঢ্যাঁড়শ বলল না তো! এই অভ্যেস আমাদের কলোনিয়ালিজম থেকে প্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক কূটনীতি এখন বাঙালির পাকশালের রন্ধন প্রণালীতে। গোলটেবিল বৈঠকের শেষেও দুম করে ইরান-ইজরায়েল।
চারপাশ খুবই স্ক্যারি। সংসদীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে লুকোনো ক্রমশ চোয়ালচাপা নিষ্ঠুরতা। লাবণ্যহীন, সহানুভূতিহীন আমোদউদ্গার। চোখের ল্যাক্রিম্যাল গ্রন্থিকে তোয়াক্কা না করা আমাদের গণতান্ত্রিকতা। নীরব বিশ্বাসকে একসময় হেজে যেতে হয় গোপন কুঠুরিতে। ফণা তোলা স্বেচ্ছাচার চারপাশে। কবিবন্ধু সুব্রত রায় (চমু) নব্বইয়ের দশকে লিখেছিল, ‘কোথায় পালাবে তুমি / চারিদিকে লোকাল কমিটি’। সেই কথাটাই এই চব্বিশে একটু পালটে দেওয়া যায়, ‘কোথায় পালাবে তুমি / চারিদিকে ছোটবড় সভাপতি’। অলজ্জ পেশিসহ ‘বেশ করেছি, করব’ ভাব নিয়ে বুলেটে ভাসমান তারা।
চারপাশ খুব খুব স্ক্যারি। সারিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদোর দালি একবার গন্ডারের পেছন সম্পর্কে বলেছিলেন, গন্ডারের পেছনটা আর কিছুই না, দু’বার ভাঁজ করা সানফ্লাওয়ার। সেইরকমই মনে হয় এই অভাগা দেশে সংসদীয় তন্ত্রের পেছনে ছুটে চলেছি সবাই – ওইরকম, গন্ডারের পেছনটা আর কিছুই নয়, দু’বার ভাঁজ করা সূর্যমুখী ফুল। আমরাও একেকজন সারিয়ালিস্ট শিল্পী। আমরা গন্ডারের সামনেও পড়ি, পালানোর চেষ্টা করি, পালাই বা মরি। আবার পেছনেও ছুটি পুরু চামড়ার ভাঁজ সূর্যমুখী ভেবে। এই-ই আমাদের স্ক্যারি নিয়তি। অথচ গন্ডার ঘাস খেয়ে চলে যায়, আমাদের সামনে পড়ে থাকে নাদি।
স্ক্যারি খুব চারপাশ। মুশকিল, আমরা সেধে ডেকে আনি বিবিধ অসুখ সামগ্রী, যা আমাদের জিন বহন করে আছে সহস্রাধিক যুগ। নিস্তার কোথায়? শরীরে-মনে সেই খেলাই খেলতে হয়। কতশত পড়াশোনা, কত গবেষণা – অবশেষে এআই টেকনলজি – তবু ‘প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা / প্রতিদিন চুরি যায় আমাদের চেতনা’। সংসদীয় তন্ত্রমন্ত্রের ফাঁকফোকরে কত ঘুঘু যে ঘুরররররর করে তার ইয়ত্তা নেই। প্রয়োজন আর সাপ্লাই চেইন এখন ক্রনিজমে আক্রান্ত। ফল যা হবার প্রতিদিনের পেপারে তার প্রতিফলন হচ্ছে। রাস্তায় ধর্না হচ্ছে। স্টেডিয়ামে ওএমআর শিট হাতে তরুণ-তরুণীদের জবাই-ভবিষ্যৎ। পোডিয়ামে পোডিয়ামে রগ-ফোলা নির্বাচনি ফ্যাদলা। শিকেয় উঠে যাচ্ছে যাবতীয় স্বপ্ন ও সন্ততি।
খুব খুব স্ক্যারি চারপাশ। প্যারাডক্সে প্যারাডক্সে ছেয়ে যাচ্ছে শহর থেকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। সংসদীয় তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক করতে ব্যস্ত। আপাতযুক্তির খই ফুটিয়ে স্ববিরোধী বিবৃতিতে ছয়লাপ করে চলেছে নানা নেতা-নেত্রী। আমরা সেইদিকে হাঁ-হাবলা গণমন প্রজাপাবলিক। ক্ষুধাহরণের সুধাভরণের উদাহরণ আমাদের হাত-মাথা-পা-পেট ইত্যাদি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। আমাদের বিদ্রোহগুলো লাশকাটা ঘরে হেজে পচে গিয়েছে। আমাদের বিপ্লব বিবৃতিতেই কেতরে পড়ে আছে। আমাদের ভেতরে ভেতরে চালাকি আর অর্থগৃধ্নুতার শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। চান্স পেলেই টাকা ছড়িয়ে দেব চারপাশে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে। কেননা আমরা সকলেই যোগ্য এবং সকলেই অযোগ্য। জমানা বহত খারাব হ্যায়, টলারাম, কিসে বিশোয়াস করে, কিসে না করে!
(লেখক নাট্যকর্মী। কোচবিহারের বাসিন্দা।)