- শৌভিক রায়
পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী একবার আইনস্টাইন বলেছিলেন, প্রত্যেকের জীবনেই একটা সময় আসে, যখন বহু বই দেখবার জন্য থামতে হয়। উত্তরের জনপদগুলির ক্ষেত্রে বইমেলা ছাড়া একসঙ্গে এত সংখ্যক বই দেখবার সুযোগ আর কোথায়? কোচবিহার বইমেলা শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে ওই কথাগুলো আবার মনে হচ্ছে।
বহু বছর আগে যখন সাগরদিঘির কাছে শহিদ বাগে কোচবিহার জেলা বইমেলা শুরু হয়, তখন কেউ ভাবেননি তার কলেবর একদিন এতটা বৃদ্ধি পাবে। বেশ কয়েক বছর রাসমেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর, এবারের বইমেলা স্থান পেয়েছে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজে। কিন্তু জায়গা পালটালেও চরিত্র কী পালটেছে বইমেলার?
না। বরং গোটা মেলাতেই বিপন্নতার একটা চোরাস্রোত বহমান। একটু নজর করলেই সেটা স্পষ্ট। অতীতে আরও বহু প্রকাশককে দেখা যেত কোচবিহার বইমেলায়। কয়েক বছর ধরে তাঁদের সংখ্যা যথেষ্ট কম। যে কয়েকজন আছেন তাঁদের সম্ভারও সামান্য। ‘স্টলের জন্য এত ছোট জায়গা বরাদ্দ হয়েছে যে, বই রাখতে পারছি না’, খেদোক্তি শিশুসাহিত্য সংসদের কর্মকর্তাদের। একই কথা অন্য স্টল মালিকদেরও।
মহানগরের বইমেলায় কিন্তু স্টল মালিকের চাইতে প্রকাশকের সংখ্যা বেশি। ফলে কোনও প্রকাশনার নির্দিষ্ট বইটি চট করে পাওয়া যায়। কোচবিহার জেলা বইমেলাতে সেই বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিত। এখানে বিভিন্ন প্রকাশনার বই নিয়ে নানা এজেন্সি দেখা গেলেও, প্রকৃত প্রকাশক পাওয়া মুশকিল। সেই অর্থে আসেননি কোনও নামী প্রকাশক।
টিমটিম করে যে কয়েকজন আছেন তাঁরাও পাঠকের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। নিজের স্কুলের কচিকাঁচাদের জন্য বই কিনতে আসা দিনহাটা নিগমনগর নিগমানন্দ সারস্বত বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অনির্বাণ নাগ দুঃখ করলেন, ‘কলকাতার বইমেলায় এই সমস্যা হয় না। জেলা বইমেলা বলেই কি এই অবস্থা?’
প্রশ্নটা খুব জরুরি। কলকাতা বা নিদেনপক্ষের শিলিগুড়ি বইমেলা থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে জেলার বইমেলাগুলি। কোচবিহারও ব্যতিক্রম নয়। অথচ চারটি সরকারি স্কুল সহ গোটা পঁচিশেক স্কুল, একাধিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজ রয়েছে এই শহরে। সঙ্গে রয়েছে মহকুমা ও অন্যান্য জনপদগুলি। সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও এই জেলার পরিচয় সবসময় আলাদা। এখনও অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বাংলা গদ্যের শুরু এই কোচবিহারেই। অমিয়ভষণ মজুমদার, অরুণেশ ঘোষের মতো সাহিত্যিকরাও এখানকার মানুষ। তবু এই হাল কেন কে জানে!
তবে নিজেদের খামতি স্বীকার করতেই হয়। বইমেলার হুজুগে যতটা মেতে উঠি, পাঠের ক্ষেত্রে ততটা সিরিয়াস নই আমরা। কদর কমেছে সুসাহিত্যের। সাংস্কৃতিক মঞ্চে কবিতা পাঠ বা আলোচনার আসরে সামনের সারি সারি ফাঁকা আসন। মহানগরের বইমেলায় এই চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি সেখানে। চলে প্রশ্নোত্তর। তবে দুপুর দুটো বা তিনটেয় শ্রোতার উপস্থিতিও আশা করা যায় না। ভেবে দেখতে হবে সেটিও। না হলে ক্ষতি কিন্তু বইমেলারই।
পৌষের রোদমাখা দিনে বইমেলা চিরন্তন। তাই নানা অভাব-অভিযোগ নিয়ে কোচবিহার বইমেলা তার নিজের মতোই আলাদা।
(লেখক কোচবিহারের বাসিন্দা, শিক্ষক)