- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
তা হলে কি আর আমাদের গর্ব করার জন্য কিছুই হাতে রইল না? অহং আসলে কাপাসতুলোর মতো বাতাসের সঙ্গে উড়ে যাওয়া কিছু?
বিশ্বজুড়ে দুটো জিনিস ভারতকে পৌঁছে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। বলিউড এবং ভারতীয় খাবার। ইউরোপ-আমেরিকায় ভারতীয় কুইজিনের রেস্তোরাঁ দেখলেই সেখানে বিদেশিদের ভিড়। ইন্ডিয়ান কুইজিন এতটাই জনপ্রিয় যে পাকিস্তানি বা বাংলাদেশিরা সেখানে রেস্তোরাঁ খুললে সাইনবোর্ডে লিখে দেয় ভারতের নাম।
এত সব গর্বের রথের চাকা মাটিতে বসিয়ে দেয় অতি টাটকা একটি খবর।
অতি সম্প্রতি টেস্ট অ্যাটলাস নামে বিশ্বের সুপরিচিত ট্রাভেল গাইড তৈরি করেছে বিশ্বের সেরা ফুড সিটির তালিকা। সেই তালিকায় প্রথম পঞ্চাশে দেখছি মাত্র দুটো ভারতীয় শহর। মুম্বই ৩৫ নম্বরে, হায়দরাবাদ ৩৯ নম্বরে। একশোর মধ্যে আর তিনটি ভারতীয় শহর। যা ভাবছেন, তা নয়। আমরা বাঙালিরা গর্ব করি কলকাতার নানা খাবার নিয়ে। তিলোত্তমার রাজপথে কতরকম বর্ণময় খাবার। কত সস্তা, কত বিচিত্র। তবে তাতে দেখা যাচ্ছে, চিঁড়ে মোটেই ভেজেনি বিশ্বমঞ্চে। একশোর তিনটি ভারতীয় শহরের মধ্যেও কলকাতা নেই। আছে নয়াদিল্লি (৫৬), চেন্নাই (৬৫) এবং লখনউ (৯২)।
ধরা যাক, আমি বা আপনি এই সংস্থার সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিলাম না। তা হলে বহুপরিচিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের শেষ সেরা ফুড সিটির তালিকায় চোখ বুলোই। প্রথম দশে লন্ডন, টোকিও, সোল, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, রোম, ব্যাংকক, সাও পাওলো, বার্সেলোনা, দুবাই। প্রথম কুড়িতেও আর কোনও ভারতীয় শহর নেই। ভারতের কোনও শহরকে রাখতে হবে বলে তালিকাটা একুশ শহরের করা হয়েছে হয়তো। কিছুটা কোটার চক্করে নয়াদিল্লি ঢুকেছে।
বর্ষবরণের প্রেক্ষাপটে পেটুক বঙ্গসন্তানরা এবার ভেবে দেখতে পারেন, বাঙালির বড় গর্বের ফুড স্ট্রিট কলকাতা কেন এখানে নেই। শুধু ভারতেই কেন পিছিয়ে। টেস্ট অ্যাটলাসের সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রত্যেক দেশের শহরগুলোর খাদ্য বৈচিত্র্য কী জায়গায়। নয়াদিল্লি এবং মুম্বই বিশ্বে বিখ্যাত বিভিন্ন চাটের জন্য। হায়দরাবাদের বিশ্বজোড়া নাম বিরিয়ানির জন্য। চেন্নাইকে জানে ধোসা ও ইডলির জন্য। লখনউকে পরিচিত করেছে মোগলাই খানার নানা পদ- কাবাব বা বিরিয়ানি। কলকাতার তা হলে রয়েছে কী?
লিখতে লিখতে এদিক-ওদিক তাকাই। সত্যিই তো, আমাদের নিজস্ব বলতে আছেটা কী। আছে অজস্র। তবে বিশ্বমঞ্চে গর্ব করে বলার মতো খাবার কলকাতার কী। ভাবি। ভাবতে ভাবতে কলকাতায় আসা ভিনরাজ্যের অভিনেত্রী, ক্রিকেটারদের অদ্ভুত উচ্চারণের কথা মনে পড়ে। ‘আমি কওলকাতার রসোগোল্লা আর মিষ্টিদই খুব ভালোবাসি।’ শুধু রসগোল্লা ও মিষ্টিদইকে সম্বল করে আমরা কি বিশ্বের খাদ্যমঞ্চে নামতে পারি? সেটা কি আদৌ সম্ভব?
টেস্ট অ্যাটলাসের সমীক্ষায় ভারতের মধ্যে মুম্বইকে এক নম্বরে দেখে মুম্বই নগরিয়ারই অনেক বাসিন্দার ভুরু কুঁচকোবে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিদের- যাঁরা কলকাতার খাবারের জন্য ব্যগ্র হয়ে থাকেন। বাংলায় এলেই দৌড়ান খাবারের দোকানে। চপ, তেলেভাজা, পাইস হোটেল, নকুড়…। অথচ ভেবে দেখুন কোনও বাঙালি খাবার কি পাওভাজির মতো বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পেরেছে? ভেবে দেখলে পাওভাজি এমনিতে খুব সাদামাটা প্রিপারেশনের। তবুও বাংলার অনেক ছোট শহরে পৌঁছে গিয়েছে এর জেল্লা।
বাঙালি হিসেবে অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে চোখ রাখি ফুড সিটির তালিকায় প্রথম শহরগুলোতে। কলকাতাকে, বাঙালির রান্নাঘরকে মেলানোর চেষ্টা করি। আমাদের আলুপোস্ত, ঝিঙেপোস্ত, বিউলির ডাল রয়েছে। আমাদের মোচার ঘণ্ট, মোচার চপ, বড়ি দিয়ে শাক রয়েছে। লুচি-ছোলার ডালের সঙ্গে চিংড়ি-ইলিশ রয়েছে। পায়েস ও মাছভাজার জন্য আমাদের অনেকে কাতর। পান্তাভাত-ভর্তার কথা ভাবলে উল্লসিত হয়ে উঠি। এত কিছু হাতে নিয়েও আমরা কি কোনও খাবারের কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে ব্র্যান্ড তৈরি করতে পেরেছি? বিরিয়ানি, কাবাব, ইডলি-ধোসা, চাট, পাওভাজির মতো? পুরোনো দিল্লির দরিয়াগঞ্জে ঘুরলে মোতিমহল নামে এক নানা রূপকথার গল্পের রেস্তোরাঁ মেলে, যেখানে জন্ম বাটার চিকেনের। রসগোল্লার জন্মস্থান নবীনচন্দ্র দাশের দোকান ছাড়া আর কোনও বিশেষ জায়গা রয়েছে কলকাতায়?
কলকাতার বিভিন্ন জায়গার বিরিয়ানি নিয়ে আমরা অনেকে পাতার পর পাতা লিখে গিয়েছি। এমন ধারণা দিতে চেয়েছি, কলকাতার বিরিয়ানি স্বর্গীয়। লখনউ বা হায়দরাবাদি বিরিয়ানি আমাদের ধারেকাছে নয়। ভালো করে ভেবে দেখা যাক, সেই বিরিয়ানি কি সত্যিই আমাদের সৃষ্টি? তা তো নয়।
সীমান্তের ওপারে তাকিয়ে দেখি, পদ্মার তীরেও অসংখ্য খাবারের ভিড়ে কিছু বলার মতো নেই বাঙালির। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় ভরে রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অধিকাংশ আবার সিলেটের লোক। সেইসব রেস্তোরাঁতেও বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় কী? না, ইন্ডিয়ান কারি, বিরিয়ানি বা বাটার চিকেন, চিকেন বাটার মশালা। তাই ঢাকার খাবারের মিছিল নিয়ে আমাদের তীব্র প্রশংসা থাকুক, বাংলাদেশেরও নিজস্ব কোনও ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি। আমাদের কলকাতা, শিলিগুড়ি, মালদায় পায়েস বা মাছভাজা খাবার ইচ্ছে হলেও কোনও দোকান খুঁজে পাবেন না। আমরা কেউ ভাবিইনি, কোনও বিশেষ খাবারকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরার কথা।
আরও একটা মহত্তর কথা। কারণটা রাজনৈতিক না সামাজিক, সেটা বলা কঠিন। তবে ভারতীয় খাবারের বিবর্তন যে অন্য মোড়ে দাঁড়িয়ে, সেটা দেশের সর্বভারতীয় টিভি সিরিয়ালের দৃশ্যগুলো থেকে স্পষ্ট। এক নামী পরিচালকের কাছে যা শুনলাম, তা রীতিমতো চমকে দেয়। প্রথমে অবিশ্বাস্য লাগলেও একেবারে বাস্তব। হিন্দি সিরিয়ালে এখন পারিবারিক খাবারের দৃশ্যে পর্যন্ত কোনও ননভেজ খাবার দেখানো যায় না। শুধু ভেজ খাবার দেখাতে হবে। নইলে নাকি, হ্যাঁ নাকি, উত্তর ভারতের আম পাবলিক সেটা নিতে পারবে না। শোয়ের টিআরপিতে প্রভাব পড়বে। বড় সব চ্যানেল কর্তারই এমন পর্যবেক্ষণ।
টেস্ট অ্যাটলাসের সমীক্ষায় খাবার নিয়ে একেবারে ছানবিন করে ফেলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। সেরা ফুডসিটির পাশাপাশি সেরা ডিশ, সেরা কুইজিন, সেরা চিজ, সেরা আইকনিক ফুড প্লেসগুলোও উজ্জ্বল।
সেরা ফুডসিটির প্রথম তিনে রয়েছে ইতালির তিনটি শহর- রোম, বোলোনা এবং নেপলস। আটে তুরিন। তাদের পাস্তা, পিজ্জা, স্প্যাগেটি, পেস্ট্রি, চিজের খাবারের জন্য। জাপানের টোকিও, ওসাকা প্রথম ছয়ে ঢুকে পড়েছে সুসি, শাকিমি, শাবু শাবু, ইয়াকিতোরি, ইয়াকিতাবুর জন্য। গোটা পৃথিবী যে স্বাদে মজেছে। আমাদের এসব কোথায়? আমাদের গর্বের কাবাবকে হারিয়ে দিয়ে চলে যায় রাশিয়ার শাশলিক, উচ্ছ্বাসের নানকে পিছনে ফেলে যায় মালয়েশিয়ার রোটি কানাই।
বিশ্বের সেরা ডিশের তালিকায় চোখে এল প্রথম পনেরোয় একটা ভারতের। না, বাটার চিকেন বা কারি, কারি বা বাটার নান নয়। বাটার গারলিক নান। সেটা সাত নম্বরে। একে ব্রাজিলের পিকানা (বিফ কাট)। যা দেখালে হিন্দি টিভি সিরিয়ালের টিআরপি কমে শূন্য হয়ে যাবে হয়তো। দুই নম্বরে থাকা মালয়েশিয়ার রোটি কানাই আমাদের নান নিয়ে গর্বকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে একেবারে। পরবর্তী জায়গার দখলদার থাইল্যান্ডের ফাত কাপরাও, ইতালির পিজ্জা নেপোলেতানা, চিনের ডাম্পলিং গুওটি, থাইল্যান্ডের নুডলস খাও সই।
আগে লিখেছিলাম বলিউডের পাশাপাশি বিশ্বে আমাদের বিজয় কেতন উড়িয়ে যায় ভারতীয় কুইজিন। কেতন ওড়ানো মানে প্রথম তিনে নয়। বিশ্বের অন্যতম খাদ্য সমীক্ষায় স্পষ্ট, ১০০ সেরা কুইজিনের তালিকায় ভারতীয় খাবার ১১ নম্বরে। ইতালি, জাপান, গ্রিস, পর্তুগিজ, চিন, ইন্দোনেশিয়া এমনকি মেক্সিকো, ফ্রান্স, স্পেন এবং পেরুও আমাদের তুলনায় এগিয়ে। তবে বৈচিত্র্যের বিচারে সেরা ভারতীয় খাবার ও মশলার সংখ্যা ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, জাপানের পরেই। ভারতের ৪৮১ হলে ইতালির ২৪৮২, ফ্রান্সের ১২১৪, স্পেনের ৮১৭- ফারাকটা কিন্তু তাকিয়ে থাকার মতো।
আমাদের সান্ত্বনা একটাই- যে বাংলাদেশি বা পাকিস্তানিরা ভারতীয় খাবারের ব্র্যান্ড কার্যত চুরি করে বিদেশের বাজারে বিশাল ব্যবসায় ব্যস্ত, তাদের দেশ আন্তর্জাতিক পর্যালোচনায় এখনও অনেক পিছনে। বিদেশে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের খাবার বলতে আজও ইন্ডিয়ান কুইজিনকেই ধরে লোকে।
আমাদের বাঙালিদের খাবার প্রীতির নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে ফুড ব্লগারদের ক্রমবর্ধমান রমরমায়। অথবা খাবার নিয়ে কাগজ এবং ওয়েবসাইটে লেখালেখিতে। তবে বিশ্বজোড়া খাদ্যসমীক্ষায় বাঙালিদের উল্লাসের কিছু দিতে পারল না ২০২৩। একেবারেই ম্রিয়মাণ বাঙালি খাদ্যমালা, এককোণে পড়ে রয়েছে অনাদরে। অতএব, হে আলুপোস্ত, সর্ষে ইলিশ, ডাবচিংড়ি, শুক্তো, মুগের ডাল, মাছভাজা, পায়েস, বাসন্তী পোলাও, লুচি-আলুর দম! তোমাদের সঙ্গে পেটুক বাঙালিরও প্রার্থনা রইল, বং ফুড নতুন বছরে অভিনব কোনও আলোর সন্ধান দেবে বিশ্বের খাদ্য প্রান্তরে।