- ভাস্কর বাগচী
দু’দিন আগে শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে দাঁড়িয়ে আমার এক সিনিয়ার সহকর্মীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেই সিনিয়ার সহকর্মী এখন ওই নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন। এখনও পর্যন্ত বিল প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ছুঁইছুঁই। লাখ তিনেক টাকা মিটিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিষেবা? পরিষেবার কথায় চোখ ছলছল করে উঠল সহকর্মীর স্ত্রীর। তিনি পেশায় সরকারি কর্মী। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছেন বড় নার্সিংহোমে। টাকার কথা চিন্তা না করে এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য, যেভাবে হোক স্বামীকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু গত প্রায় ১০ দিনে তাঁর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। শরীর থেকে জল বের করার নামে পেটের দুই দিকে চিকিৎসকের নির্দেশমতো পাইপ ঢোকাতে গিয়ে একেবারে রক্তারক্তি। প্রতিবাদ করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটে গিয়েও কোনও কাজ হয়নি। বিনিময়ে মিলেছে ঝাঁঝালো কথাবার্তা। ।শিলিগুড়ি শহরে এই নার্সিংহোমের ঘটনাটি একটি উদাহরণ মাত্র। গোটা উত্তরবঙ্গের চিত্র প্রায় একইরকম। ফলে হাজারো সুযোগসুবিধা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দেওয়া হলেও এখানকার মানুষ দক্ষিণ মুখে ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সেখানে ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে দেখা হলেই রোগ অর্ধেক সেরে যায়। তাহলে এই উত্তরবঙ্গে গলদটা কোথায়?
কয়েকজন পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথায় কথায় জানা গেল, নার্সিংহোমগুলিতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো কাজ করতে হয় তাঁদের। তাই সব ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের হাত-পা বাঁধা থাকে। কারণ ভালো নার্সিংহোমে টিকে থাকলে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন বাড়ে, তেমনই বাড়ে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি,।কিন্তু পাড়ার ওষুধের দোকানে চেম্বার করলে সেই পরিচিতি পেতে সময় লাগে অনেক। তাই নার্সিংহোমগুলির দেওয়া ‘টার্গেট’ পূরণ অনেক চিকিৎসকেরই প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। যাঁরা নার্সিংহোমে চিকিৎসা করানোর আর্থিক সামর্থ্য রাখেন, তাঁরা সবাই কিন্তু চান, টাকা গেলে যাক, নার্সিংহোমে ভর্তি তাঁদের পরিজনটি যেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। নার্সিংহোমে ভর্তির পর রোগী কিন্তু পুরোপুরি চলে যান নার্স, চিকিৎসকদের হেপাজতে।
তখন রোগীর পরিবারের কথা খুব একটা গ্রাহ্য হয় না। এমনকি পরিবারের রোগীটি আজ কেমন আছেন, সেই তথ্যটুকু জানতেও অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাও সেটা ডাক্তারবাবুদের মুডের উপর নির্ভর করে। উত্তরবঙ্গের অনেক নার্সিংহোমেই রোগী দেখতে যাওয়া ডাক্তারবাবুর পিছনে রোগীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পরিজনকে ছুটতে দেখা যায়। ডাক্তারবাবু গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মুড ভালো থাকলে কিছু বলবেন। আর যদি মুড খারাপ থাকে, তাহলে মুখঝামটা খেয়ে ফিরতে হবে রোগীর পরিবারকে। অথচ দক্ষিণে যাঁরা চিকিৎসা করাতে গিয়েছেন একবার, তাঁদের অভিজ্ঞতা হল, চিকিৎসকরা সব রোগী ও তাঁর পরিজনের সঙ্গে কথা বলায় যে সময় দেন, তা কল্পনাও করতে পারবেন না এখানকার চিকিৎসকরা। তবে সব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী চরিত্র কিছু থাকে। চিকিৎসকদের মধ্যেও কয়েকজন আছেন, যাঁরা এখনও ‘মানুষকে মানুষ’ ভাবেন। হাতেগোনা কয়েকটি নার্সিংহোমে আবার চিকিৎসা করিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন অনেকে। তবে সেই সংখ্যাটা একেবারে নগণ্য।।
প্রশ্ন ওঠে, রাজ্যের সরকার কি নার্সিংহোমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না? উত্তর, অবশ্যই পারে। কিন্তু ওই যে, নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা না হলে, কেউই এসবের বিরুদ্ধে সরব হন না। অনেকের মনে হতে পারে, কেন এমন বললাম। আসলে নার্সিংহোমে দলনির্বিশেষে নেতা বা মন্ত্রীরা চিকিৎসা করাতে গেলে তাঁদের ভিভিআইপি পরিষেবা দেওয়া হয়। তাতে সন্তুষ্ট থাকেন নেতা-মন্ত্রীরা ও তাঁদের দল। তাই তাঁরা বাস্তবটা বুঝতে পারেন না। সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেন। দুই-একটা অভিযোগ নিয়ে কিছুদিন চ্যাঁচামেচি হয়। আবার ক’দিন পর চুপচাপও হয়ে যায়। প্রতিবাদ, অভিযোগ? নার্সিংহোমে ভর্তির সময়, খুব ক্ষুদ্র হরফে যে পাতার পর পাতায় লেখার নীচে আপনাকে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়, তাতেই লুকিয়ে থাকে নানা গ্যাঁড়াকল। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর পরিজন অভিযোগ জানালেও তা বেশিদূর এগোয় না। জয় হয় নার্সিংহোমের। আমজনতাও আবার নতুন কোনও বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘটিবাটি বেচে চিকিৎসা করাতে যাওয়া রোগীর পরিষেবা থেকে যায় সেই তিমিরেই।