- অতনু বিশ্বাস
অর্থনীতির প্রেক্ষিতে একটা নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। শুধু কি অর্থনীতি, শব্দটা সামাজিক প্রেক্ষিতেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক অতীতে। হ্যাঁ, এ এক সাম্প্রতিক প্রবণতা। আসলে অতিমারি-উত্তর সমাজের মানসিকতার খানিকটা প্রতিফলন ঘটেছে শব্দটার মধ্যে। এই শব্দটাই ‘ফানফ্লেশন’।
কী এই ‘ফানফ্লেশন’? কোভিড-পরবর্তীকালে পৃথিবীজুড়েই বিনোদন ক্ষেত্রে খরচ বেড়েছে অনেকটাই। বেড়েছে সরাসরি পরিবেশনযোগ্য বিনোদনের টিকিটের মূল্য। অর্থাৎ সিনেমা, কনসার্ট, খেলার টিকিটের দাম। মজার কথা হল, দেখা যাচ্ছে যে মানুষও কিন্তু এসবের জন্য বেশি খরচ করতে রাজি। টেলর সুইফটের কনসার্টের টিকিটের দাম ডলারে চার অঙ্কে পৌঁছেছে। কিন্তু তাতে উপচে পড়ছে মানুষ। বেড়েছে ডিজনি থিম পার্কের টিকিটের দাম। নামীদামি খেলার টিকিটের দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে। অর্থাৎ মানুষ এসব বিনোদনের পিছনে খরচ করছে দেদার। সংসারের বাজেট আঁটোসাঁটো, জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। তবু মানুষ বেড়াতে ছুটছে, দামি শপিং মলে ভিড় জমাচ্ছে, সিনেমা-থিয়েটারের দামি টিকিট কাটছে, ভালো খেলার টিকিট খুঁজছে।
এটা কিন্তু বেশ আশ্চর্যেরই। প্রথাগত ভাবনাচিন্তা, মানসিকতা এবং অর্থনৈতিক জ্ঞানের গণ্ডির বাইরের ঘটনাপ্রবাহ। কারণ, অতিমারি-পরবর্তী সময়কালে দুনিয়াজুড়ে হয়েছে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি। আর মূল্যবৃদ্ধি বা ইনফ্লেশনের সময় মানুষকে বাধ্য হয়েই খরচ করতে হয় চেপে। তাই চড়া মূল্যবৃদ্ধির সময় মানুষ সাধারণত খরচ করে প্রয়োজনীয় জিনিসের উপরই, যেটুকু না করলে নয়। কারণ তার বাজেট তো সীমাবদ্ধ। এটাই দস্তুর। কিন্তু, কী আশ্চর্য, দুনিয়াজুড়ে আজ উলটো ছবি। রীতিমতো তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যাংক অফ আমেরিকা দেখিয়েছে যে ২০২৩-এর গ্রীষ্মে উত্তর আমেরিকার উপভোক্তারা তাদের রোজগারের প্রেক্ষিতে দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসের চাইতে ‘ফান’ বা বিনোদনের অভিজ্ঞতার পিছনে খরচ করেছে অনেক বেশি এবং শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকাতেই নয়, এই ধারা দেখা যাচ্ছে দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই। ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ব্লকব্লাস্টার সিনেমা, পুজো কিংবা বড়দিনে বেড়াতে বেরিয়ে আমাদের দেশের জনগণও কিন্তু খরচ করে চলেছে হাত খুলে।
সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। ব্যাংক অফ আমেরিকা আর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো সংস্থারা এর নাম দিয়েছে ‘ফানফ্লেশন’। এ এক হাঁসজারু ধরনের শব্দ, ‘ফান’ আর ‘ইনফ্লেশন’-এর খিচুড়ি পাকিয়ে তৈরি। আসলে অতিমারির সীমাবদ্ধ দুনিয়াতে একশ্রেণির মানুষের সঞ্চয় বেড়েছে। সঙ্গে থেকে গিয়েছে অবদমিত খরচের আকাঙ্ক্ষা। এসবেরই মিলিত ফলশ্রুতি হল ‘ফানফ্লেশন’, এমনটাই বলছে ‘ফানফ্লেশন ইন ফুল ফোর্স’ শীর্ষক ব্যাংক অফ আমেরিকার সেপ্টেম্বরের এক রিপোর্ট। মানুষের এই মানসিকতার সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছে টেলর সুইফট আর বিয়ন্সের মতো সংগীত-তারকার জাদু কিংবা বার্বি বা ওপেনহাইমারের মুভির ম্যাজিক।
এই সময়কালের এই ব্যতিক্রমী মানসিকতাকে কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন না অনেক বিশেষজ্ঞ। বরং মনে করছেন যে জনগণের এই মানসিকতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াই সম্ভব। ঘটনাচক্রে গীতিকার-গায়িকা টেলর সুইফট এই ‘ফানফ্লেশন’ ধারার প্রধান পুরোধা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। তাঁর সংগীত-জীবনের বিভিন্ন ‘এরা’ বা যুগকে জোড়া দিয়ে যে ‘এরাজ ট্যুর’ নিয়ে তিনি বেরিয়েছেন দুনিয়া জয় করতে তা জোগাবে ৫ বিলিয়ন ডলারের চাইতেও বেশি। দর্শক ও ভক্তদের টিকিট, যাতায়াত, হোটেল, খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা মিলিয়ে। সাধারণভাবে খেলা বা অন্য বিনোদনের টিকিটে ১০০ টাকা খরচ হলে এইসব সহযোগী ক্ষেত্রে অর্থাৎ যাতায়াত, হোটেল, কেনাকাটা, ইত্যাদিতে খরচ হয় ৩০০ টাকা। এটাই গড়পড়তা হিসেব। টেলর সুইফটের ভক্তরা কিন্তু এই খরচটাকে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকার গণ্ডিতে নিয়ে ফেলেছেন। স্থানীয় অর্থনীতি এর সুফল পাচ্ছে সর্বত্র। ‘এরাজ ট্যুর’-এর প্রতিটা শো-তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গড়ে ৩৬ মিলিয়ন ডলারের জোগান ঘটছে সংশ্লিষ্ট শহরের স্থানীয় অর্থনীতিতে। কর্মসংস্থান হচ্ছে গড়ে ৩০০ মানুষের। ‘এরাজ ট্যুর’-এর শো যেখানে যেখানে হচ্ছে সেই শহরগুলিতে গত বছরের তুলনায় হোটেলের চার্জ বেড়েছে গড়ে ৭.২ শতাংশ।
এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতেই পারে যে এই ‘ফানফ্লেশন’টা আসলে টেলর সুইফট-কে নিয়ে মাতামাতির ফল। কিন্তু তাই একমাত্র নয়। ম্যাজিক দেখাচ্ছেন বিয়ন্সের মতো পপ গায়িকাও। তাঁর ‘রেনেসাঁ’ ওয়ার্ল্ড ট্যুর জোগান দিতে পারে আনুমানিক সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের। এছাড়াও লিজ্জো, রেড হট চিলি পেপার্স, বিলি জোয়েল আর স্টিভ নিকস, হ্যারি স্টাইলস, আরও অনেক গায়ক এবং ব্যান্ডও ম্যাজিক দেখাচ্ছে অর্থনীতির মানদণ্ডে।
মোটের উপর বিনোদন বোধকরি কখনোই এতটা খরচসাপেক্ষ ছিল না। এটা ঠিক যে সব রকমের বিনোদনেরই খরচ বেড়েছে। যাতায়াত, সিনেমার টিকিট, কনসার্টের টিকিট, খেলার টিকিট, রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া, সবকিছুর। আমেরিকায় ২০২২-এর অক্টোবরের তুলনায় ২০২৩-এর অক্টোবরে খেলার টিকিটের দাম গড়ে বেড়েছে ২৫.১ শতাংশ। সাধারণভাবে মেজর লিগ বেসবল কিংবা ন্যাশনাল বাস্কেটবল লিগের টিকিটের দাম তো বেড়েইছে। সেই সঙ্গে লাস ভেগাসে ফর্মুলা ওয়ান রেস বা লিওনেল মেসির ইন্টার মিলানে ট্রান্সফারও প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার করেছে। খেলায় খরচ বেড়েছে এসবেরও ফলশ্রুতিতে। সব মিলিয়ে খেলা, সিনেমা, কনসার্ট এবং অন্যান্য ইভেন্টের টিকিটের পিছনেই আমেরিকানরা মোটামুটি ৯৫ বিলিয়ন খরচ করেছেন ২০২৩-এ, যা আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।
মজার কথা হল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যখন অবশেষে স্থিততায় পৌঁছাচ্ছে, বিনোদনের খরচ কিন্তু বেড়েই চলেছে। এর পিছনে কারণ হয়তো অনেক। অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় সরাসরি পরিবেশনযোগ্য বিনোদনকে দেখা হচ্ছে আত্মিক সমৃদ্ধির পথ হিসেবে। এ যেন এমন এক অনুভব যা আত্মিক বা মানসিক ক্ষেত্রে এক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। জীবনের চলার পথে যেন এক অমূল্য অভিজ্ঞতা। মিলেনিয়াল এবং জেনারেশন জেড-এর তরুণরা এই মানসিকতার শরিক। মোটের উপর ‘ফানফ্লেশন’ জোগান দিচ্ছে এমন এক প্রবল হাওয়ার যা ব্যবসা-ক্ষেত্রের তাবড় তাবড় সিইও-রও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফরচুনের মোস্ট পাওয়ারফুল উওম্যান সামিটে বেস্ট বাই-এর সিইও কোরি বেরি সম্প্রতি বললেন, মানুষ বিনোদনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফানফ্লেশন… এই অভিজ্ঞতার জন্য খরচ করতে রাজি মানুষ। ইলেক্ট্রনিক্সের দামি জিনিস কিনতে তারা এখন আগ্রহী নয়।
টেলর সুইফট এবং বিয়ন্সের মতো অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী বিনোদনকারীদের হাত ধরে এই ‘ফানফ্লেশন’-এর আবির্ভাব, নিশ্চয়ই। তবু অনেকেই মনে করছেন, এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হবে। হয়তো তা মরশুমি হিসেবে ঘুরেফিরে আসবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে। হয়তো প্রাবল্য নিয়ে আসবে প্রতি গ্রীষ্মে। সব সময় এমন অসাধারণ শিল্পীর অবদানের ফলে না হোক, অনেক শিল্পীর সম্মিলিত অবদান ‘ফানফ্লেশন’কে বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যেমন, সব সময় বার্বি কিংবা ওপেনহাইমারের মতো না হলেও মাঝারি মাপের সাফল্য আসবে অনেক ছবির হাত ধরে। লিওনেল মেসি না হোক, খেলার দুনিয়ায় উত্তেজনা জোগাবেন অন্য অনেক খেলোয়াড় মিলে যাঁরা হয়তো মেসির পর্যায়ের নন। মোট কথা, অনেকেই মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সাহায্য করবে এই ‘ফানফ্লেশন’। তবে সেই সঙ্গে কিন্তু থেকে যায় আশঙ্কাও। ডট-কম বুদবুদ যেভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল অথবা কোভিডের ফলে মন্দা এসেছিল যেমন, সেই আশঙ্কা।
যাই হোক, টেলর সুইফট কিংবা বিয়ন্সের মতো অসাধারণ শিল্পীরা যে এই ‘ফানফ্লেশন’ ধারার পুরোধা, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে, মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে কোভিড অতিমারি-উত্তর এক অনন্য সময়কালই বোধকরি এই ‘ফানফ্লেশন’-এর প্রধান উপাদান। এক ব্যতিক্রমী সময়কালই এক বিপ্লব এনেছে মানসিকতার চিরন্তন রূপরেখায়। যা হঠাৎ ঝড় নাকি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা তা বোঝা এখনই কঠিন। আসলে ‘ফানফ্লেশন’-এর হদিস বুঝতে সিইও থেকে অর্থনীতির তাত্ত্বিক পণ্ডিতরা কিংবা তাবড় সমাজতত্ত্ববিদরাও যে হিমসিম খাচ্ছেন।
(লেখক কলকাতার আইএসআইয়ের অধ্যাপক)