Sunday, May 12, 2024
Homeকলামধর্ম নিয়ে রাজনীতির দায় সবার

ধর্ম নিয়ে রাজনীতির দায় সবার

  • রন্তিদেব সেনগুপ্ত

শোনা যায়, বুকে তিনটি বুলেট ধারণ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন, ‘হে রাম।’ ঠিক কী বলেছিলেন, কী বলেননি, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তারপর সাতটি দশক পেরিয়ে গিয়েছে। ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে আরেকটি লোকসভা নির্বাচন। তার আগে আজ সোমবার অযোধ্যায় উদ্বোধন হতে চলেছে রাম মন্দিরের। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই রাম মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দেশের একাংশ জনগণের ভিতর একটি উন্মাদনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই উন্মাদনা এবং আবেগ সৃষ্টি করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির।

এটা এখন আর বলে বোঝানোর দরকার নেই যে, রাম মন্দির উদ্বোধন নিতান্তই রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের ধর্মীয় কোনও অনুষ্ঠান নয়। বরং এটি পুরোপুরিই বিজেপি এবং সংঘের একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচিটি সফল করার জন্য সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক দুই শক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের আগে রাম মন্দির হল বিজেপির তুরুপের তাস।

বিরোধীরা অভিযোগ করছে, বিজেপি ধর্মকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলি থেকে নির্বাচনের আগে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। এরই পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের চারটি পীঠের শংকরাচার্যরা রাম মন্দির উদ্বোধন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাম মন্দির নির্মাণের কাজ এখন অসম্পূর্ণ। এই অবস্থায় সেখানে রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠা অশাস্ত্রীয়। বিজেপি এবং সংঘ অবশ্য এসব কোনও সমালোচনা ও বিরোধিতাতে কান দিতেই রাজি নয়। তারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের বকলমে মন্দির উদ্বোধন করতে চলেছে।

বিজেপি ধর্মকে সুকৌশলে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে একথা সত্যি এবং এই কাজটি তারা সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই করছে। কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার দায় একা কি বিজেপির? বিজেপির বিরোধী জোটে যে দলগুলি রয়েছে তাদেরও কি একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না? বিজেপির আজ যে এই রাজনৈতিক উত্থান, তার পথটি কি তারাই প্রশস্ত করে দেয়নি?

একটু পিছনপানে ফিরে তাকানো যাক। রাজীব গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার যখন দিল্লির ক্ষমতায়, তখন তালাকপ্রাপ্ত শাহ বানু খোরপোশ পাবেন বলে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মুসলিম মৌলবাদীদের রুষ্ট করে। তাঁর সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক নষ্ট হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় রাজীব সরকার কার্যত সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে অস্বীকার করে মুসলিম মৌলবাদীদের মন রাখতে সংসদে একটি আইন পাশ করিয়ে তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলাদের খোরপোশের অধিকার নাকচ করে দেয়। এর কিছুদিন পরেই আবার কট্টর হিন্দুদের মন রক্ষা করতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা অযোধ্যায় রামলালার গর্ভগৃহের তালাটি খুলে দেন পূজাপাঠের জন্য।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে সেদিন কংগ্রেস এবং রাজীব একটি ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। পরের নির্বাচনেই মাত্র দুটি আসন থেকে একলাফে বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল আশিতে। বিজেপির রথের অগ্রগতি তারপর থেকে কিন্তু কংগ্রেস আর আটকাতে পারেনি। বরং বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি ক্রমশ আরও জোরদার হয়েছে। হিন্দুত্বের আবেগে আরও জোয়ার আনতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি।

বিজেপির এই হিন্দুত্বের রাজনীতিকে কালক্রমে সফল করতে আরও সহায়ক হয়েছে সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো আঞ্চলিক দলগুলির ভোটের স্বার্থে অযৌক্তিক এবং মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যালঘু তোষণ। এই দলগুলি ধরেই নিয়েছিল, মুসলিম মৌলবাদীদের মন রাখলেই বুঝি মুসলমান মন জয় করা যায়। এই ভাবনাটিও তাদের ভুল ছিল।

এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমাম ভাতা চালু করার পর আমার বেশ কিছু আলোকপ্রাপ্ত মুসলিম বন্ধুবান্ধব আমাকে বলেছিলেন- এই রাজনীতি হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের আরও দূরত্ব সৃষ্টি করবে। বাস্তবে করেছেও তাই। আর যত এই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তত বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রথ তরতর করে এগিয়েছে। মুসলিম মনের ভাষা পড়তেও যে বিরোধীরা ভুল করেছিল, তার একটি প্রমাণ নরেন্দ্র মোদির সরকার তাৎক্ষণিক তালাককে নিষিদ্ধ করে মুসলিম মহিলাদের একটি অংশের মন জয় করে নিতে পেরেছিল। যা অনায়াসেই করতে পারত কংগ্রেস, যা করতে পারত সমাজবাদী বা তৃণমূল কংগ্রেস- মোদি সেই কাজটি করে রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলেছিলেন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে।

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে রুখতে আরও একটি ভুল করেছে এই বিরোধীরা। বিজেপির মোকাবিলায় নরম হিন্দুত্বের পথেও পা বাড়িয়েছে। মধ্যপ্রদেশে কমল নাথ বজরঙ্গবলীর মন্দির বানিয়েছেন তো এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জগন্নাথ মন্দির বানাচ্ছেন। তাতে লাভ কিছুই হয়নি। হিন্দুত্বে যাদের মন মজেছে তারা এই নরম হিন্দুত্বের বদলে বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বকেই বেছেছে। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচন তার প্রমাণ।

তবে, এই রাজনীতিতে একমাত্র ব্যতিক্রম বামপন্থীরা। তাঁরা অন্তত ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেলাননি। এক্ষেত্রে তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। আসলে বিরোধীরা বিজেপির সযত্নে বিছানো ফাঁদেই পা দিয়ে এসেছেন এতদিন। যে রাজনীতিটি তাঁদের করার কথা ছিল সেটিই করেননি। যেসব জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে মানুষকে আরও সচেতন করা উচিত ছিল সেটিই করেননি। নিজেদের যে ঐক্যবদ্ধ ছবি তুলে ধরা উচিত ছিল তাও ধরেননি। এখনও যে সে চেষ্টা খুব আন্তরিকভাবে করছেন এমনও নয়। কাজেই আজ বিজেপিকে রুখতে যতই সংহতি মিছিল করুন না কেন , দিনের শেষে তাঁদেরও না বলতে হয়, ‘হে রাম।’

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL | ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই বধ কেকেআরের, প্লে অফের টিকিট নিশ্চিত কলকাতার

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে হারিয়ে আইপিএলের প্লে অফে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিল কেকেআর(KKR)। এদিনের খেলায় টসে জিতে বোলিং করার...

Asansol | আম কুড়োতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, বজ্রাঘাতে মৃত্যু বিজেপি কর্মীর ছেলের

0
বারাবনি: বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির অদূরে আম কুড়োতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলো এক বিজেপি কর্মীর ছেলের। শনিবার বিকেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে আসানসোলের বারাবনি থানার খড়াবড়...

Maynaguri | অভাবের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নজির কৃতী পড়ুয়ার, উচ্ছ্বসিত গোটা গ্রাম

0
ময়নাগুড়ি : দারিদ্র্যের মাঝেও নজির প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়ার। ময়নাগুড়ি ব্লকের পানবাড়ি এলাকার ভবানী হাই স্কুলের ছাত্রী রুমা রায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৬০ নম্বর পেয়ে...

Siliguri | শিলিগুড়িতে রাতে প্রবল বর্ষণ, কিছু জায়গায় দাঁড়ালো জল

0
শিলিগুড়ি : অবশেষে প্রবল বৃষ্টি শিলিগুড়িতে। যার ফলে ব্যহত হল শহরের রাতের নগর জীবন। মনে করালো নববর্ষের সন্ধ্যে রাতের কথা। আজ রাতে বৃষ্টি হয়েছে...

Darjeeling | দার্জিলিঙে হেনস্তার শিকার সমতলের গাড়িচালকরা, ছড়াচ্ছে ক্ষোভ

0
শিলিগুড়ি: নির্দিষ্ট পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করলেও জরিমানা করছে দার্জিলিং(Darjeeling) ট্রাফিক পুলিশ। পাশাপাশি লালকুঠি, হাওয়া ঘর সহ একাধিক জায়গায় গাড়ির চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে...

Most Popular