সানি সরকার, শিলিগুড়ি: ১৪৯ বছর পেরিয়ে মোরগটি সোমবার ১৫০ বছরে পা দিয়েছে। বয়স হলেও পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ, নজর তার সর্বত্রই টানটান। ভবিষ্যদ্বাণী আজকাল অনেকটাই নির্ভুল। কারও কাছে হেঁয়ালি বলে মনে হলেও অনেকে হয়তো ঠিকই ধরেছেন। এই সেই আবহাওয়া–মোরগ। বছরের পর বছর ধরে যে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্দেশ করে চলেছে। দেশের প্রতিটি আবহাওয়া নির্ধারণ কেন্দ্রেই একে দেখা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছরেরও আগে এই মোরগের জন্ম। বকলমে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের জন্ম। এই মোরগের হাত ধরেই এই দপ্তর সোমবার ১৫০ বছরে পা দিচ্ছে।
দপ্তরের এই দেড়শো বছরের পথচলা অবাক করার মতোই। যখন এই দপ্তর ছিল না তখন আকাশে চোখ রাখাই একমাত্র ভরসা ছিল। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এবং চাণক্যর ‘অর্থশাস্ত্র’- তে জলবায়ুর কথা উল্লেখ রয়েছে। জলবায়ুর ওপর চোখ রেখে যে আবহাওয়ার মতিগতি নির্ধারণ সম্ভব, তারও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এই সূত্র ধরেই জলবায়ু বা আবহাওয়া নির্ধারণ গুরুত্ব পায়। আবহাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের একদল বিজ্ঞানী বোঝাতে সক্ষম হন। যার জেরে গভর্নর জেনারেল কাউন্সিল ইন্ডিয়ান মেট্রোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি) বা ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর স্থাপনে সম্মত হয়। ১৮৭৫ সালে দপ্তরের সৃষ্টি। দপ্তরের বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রর বক্তব্য, ‘ওই দিনটি ভারতীয় আবহাওয়ার নবজাগরণ।’ আইএমডি স্থাপনের দুই বছরের মধ্যে কলকাতার আলিপুরে দেশের প্রথম অবজার্ভেটরি সেন্টার তৈরি হয়। যা এখন আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। এখানকার প্রাক্তন অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর নানান ইতিহাসের সাক্ষী।’
দুটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে আইএমডি’র ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বুঝে ভারত যেমন প্রতিপক্ষের ডেরায় হামলা চালাতে পেরেছে, তেমনই শক্রর আক্রমণ ঠেকাতে পেরেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে রাডারের ব্যবহার বিমান চলাচলে সহায়ক হয়ে ওঠে। ফ্লাড মেট সার্ভিসের জন্য কোথায় বন্যা হতে পারে, তার একটা পূর্বাভাস এই সময়কাল থেকেই পাওয়া শুরু। ১৯৬০-এ ভারত স্যাটেলাইটের সাহায্য পেতে শুরু করে। তবে ১৯৭৫ সালে ইনস্যাট সিরিজ ভারতকে বিশ্বের কাছে বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়।
মসৃণ পথ চলার পথে বহু কাঁটাও রয়েছে। ১৯৭০–এ অন্ধ্রপ্রদেশে ১০ হাজার এবং পরের বছর ওডিশাতে ঘূর্ণিঝড়ে ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু। ’৭০-এ বাংলাদেশে তিন লক্ষ মানুষ মারা যায়। ২০০৪–এ আন্দামানের সেই বিধ্বংসী সুনামিই বা কম ভয়ংকর কীসে! ঠিকমতো ভবিষ্যদ্বাণী না দিতে পারার যন্ত্রণা দপ্তরের কর্মীদের কুরে-কুরে খেয়েছে। তবে হতাশায় ভেঙে না পড়ে তাঁরা দৃঢ় মানসিকতায় পথ চলতে চেয়েছেন। এই মানসিকতাই তাঁদের এগিয়ে চলতে সাহায্য করছে বলে আবহাওয়া দপ্তরের সিকিমের কেন্দ্রীয় অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা জানিয়েছেন।
১৫০ বছরের সূচনা পর্বেই শুধু নয়, আরও হাজার হাজার বছর ঠিকমতোই ডেকে সবাইকে ভালোভাবে রাখতে চায় আমাদের আপন মোরগ।