দীপ সাহা, শিলিগুড়ি: সেই অর্থে তালিম নেননি কোনওদিনই। প্রতি রবিবার বন্ধুদের সঙ্গে গিটার হাতে গাইতে যেতেন স্থানীয় চার্চে। চার্চের ঘর থেকে তাঁর তোলা গানের সুর ও কলি ছড়িয়ে পড়ত দূর পাহাড়ে। স্বপ্ন ছড়াত যুবক অ্যালবার্টেরও। সেখান থেকেই শুরু। তারপর কখনও সদলবলে আবার কখনও একাই গান গাইতে উঠে পড়তেন মঞ্চে। দর্শকের তালি মন ছুঁয়ে যেত তাঁর। ছড়িয়ে পড়তে চাইতেন দূরে, আরও দূরে। কালিম্পং পাহাড়ের সেই অ্যালবার্ট কাবো লেপচার স্বপ্নপূরণ হল রিয়েলিটি শো’র হাত ধরে। সারেগামাপা’র নতুন চ্যাম্পিয়ন হলেন বছর ২৭-এর অ্যালবার্ট। নতুন তারকা পেল উত্তরের পাহাড়।
সালটা ২০০৭। ইন্ডিয়ান আইডল-এ গাইতে গিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের ভূমিপুত্র প্রশান্ত তামাং। তাঁকে জেতাতে একজোট হয়েছিলেন পাহাড়ের গোর্খারা। গোর্খা আবেগে ভর করেই ইন্ডিয়ান আইডলে সেরা হয়েছিলেন প্রশান্ত। তৈরি হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। সেইসঙ্গে নতুন করে চাগাড় দিয়ে উঠেছিল গোর্খা আন্দোলন। উঠে এসেছিলেন বিমল গুরুং এবং কোম্পানি। সময়ের চোরাস্রোতে দার্জিলিং থেকে কার্যত হারিয়ে গিয়েছেন প্রশান্ত। অ্যালবার্টকে নিয়ে যখন হইচই পাশের পাহাড়ে, তখন কার্যত লাইমলাইট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন পাহাড়ের একসময়ের সুপারস্টার। প্রশান্তর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরাই জানাচ্ছেন, মাঝে নেপালে কিছুদিন সিনেমার কাজ করেছেন। কলকাতায় পুলিশের চাকরিতেও নাকি তিনি নিয়মিত নন। কোথায় আছেন কেউ জানেন না। যোগাযোগও নেই। এককথায় নিভৃতবাসে।
মুম্বইযে রিয়েলিটি শো’র মঞ্চ জয় করে সোমবার বাগডোগরা হয়ে ঘরে ফিরেছেন পাহাড়ের নতুন সুপারস্টার অ্যালবার্ট। তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে সকাল থেকেই অধীর আগ্রহে ছিলেন কালিম্পংবাসী। কিন্তু উড়ানে দেরি হওয়ায় কালিম্পং পৌঁছোতে রাত হয়ে যায় অ্যালবার্টের। তিনি বলছেন, একটা স্বপ্ন সত্যি হল। সত্যি কথা বলতে, এই প্রতিযোগিতায় প্রত্যেকেই অসম্ভব গুণী। তাঁদের সঙ্গে একমঞ্চে গাইতে পেরে আমি অভিভূত। মাটির কাছাকাছি থাকা অ্যালবার্ট তাঁর এই সাফল্যের কৃতিত্ব তুলে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী পূজাকেই। কারণ এই সাফল্যের গল্পের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক করুণ কাহিনীও। মাস কয়েক আগেই কোলের সন্তানকে হারিয়েছিলেন অ্যালবার্ট-পূজা। সন্তানশোক বুকে নিয়ে এমন মঞ্চে গাওয়াটা যে কতটা কঠিন, তা অ্যালবার্টের চাইতে ভালো কেউ জানেন না।
প্রশান্তকে জেতাতে পাহাড় যেভাবে একজোট হয়েছিল, একই ছবি এবার দেখা গিয়েছে অ্যালবার্টের ক্ষেত্রে। শহর কালিম্পংজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অ্যালবার্টের পোস্টার, পাহাড়ে যেমনটা হয় আর কী। রিয়েলিটি শো’র ভোটে অ্যালবার্টকে জেতাতে ময়দানে নেমেছিল খুদেরাও। পাহাড়ের প্রায় প্রতিটা বেসরকারি স্কুলেই অ্যালবার্টের সমর্থনে সুর তুলেছিল ছাত্রদল। সেই অ্যালবার্টই স্বপ্ন সত্যি করে সেরার শিরোপা ছিনিয়ে আনলেন। স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত কালিম্পংয়ের বাসিন্দারা। ডম্বরচকের বাসিন্দা প্রদীপ ছেত্রীর কথায়, অ্যালবার্ট আমাদের গর্ব। কালিম্পংয়ে নাম উজ্জ্বল করেছে ওঁ। প্রতিটা শোয়ে ওঁ বিচারকদের মন জয় করেছে, এটাই আমাদের কাছে বড় প্রাপ্তি।
বাবার মৃত্যুতে তাঁর পুলিশের চাকরি পেয়েছিলেন প্রশান্ত। দার্জিলিং ছেড়ে তাঁর ঠিকানা হয়েছিল কলকাতা। অ্যালবার্টেরও তাই। সারেগামাপা বাংলায় অংশ নিতে কালিম্পং ছেড়ে সস্ত্রীক গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে পেট চালাতে কাজ করেছেন টুরিস্ট গাইড হিসেবেও। কিন্তু বাংলার ওই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে থেমে যেতে হয় তাঁকে। মাঝে জীবনে আসে প্রচুর ঝড়ঝাপটা। সেইসব সামলেই বড় মঞ্চে উজ্জ্বল অ্যালবার্ট। সারেগামাপা’র ফাইনালের মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন গোবিন্দা। বাংলার ছেলের কণ্ঠে মুক্তো ঝরে পড়তে দেখে আপ্লুত গোবিন্দা বলেছেন, এ কী গাইলে তুমি! রিয়েলিটি শো’টিতে সেরা পাঁচ প্রতিযোগীর মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন বাংলার। কিন্তু তাঁদেরকে টপকে সেরার সেরা কালিম্পংযে অ্যালবার্ট। এরপর কী? মুচকি হেসে তাঁর জবাব, এটা সবে শুরু। বাকিটা সময় বলবে।