- গৌতম সরকার
নামের কলঙ্ক বৈকি। কোথায় মোঘল সম্রাট শাহজাহান। কোথায় সন্দেশখালির শাহজাহান।
আগ্রার তাজমহল এক অমর কীর্তি। দেশে-বিদেশে সমাদৃত। ভারতের অন্যতম স্মারকে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহান। সন্দেশখালির শাহজাহান অবশ্য জনপরিসরে নিন্দিত, ধিক্কৃত। অথচ এই শাহজাহান তৃণমূলের সম্পদ। দলের সজ্জন নেতা বলে পরিচিত শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় অন রেকর্ড বলেছেন, শাহজাহানকে নিশানা করে সন্দেশখালিতে গিয়েছিল ইডি।
আজ না হোক কাল তাঁকে হয়তো গ্রেপ্তার করতে হবে। যেমন করতে হয়েছে আরাবুল ইসলামকে। যাঁকে একসময় তাজা নেতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তৃণমূলের ‘কালারফুল’ নেতা মদন মিত্র। আরাবুলের দাপটে একসময় ভাঙড়ে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খেত প্রায়। এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রেজ্জাক মোল্লাকে পর্যন্ত তাঁর প্রতাপে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। সেই আরাবুল এখন জেলে। যত দিন যাচ্ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে, কতটা আশ্রয়, প্রশ্রয় পান ওঁরা।
অথচ এঁদের জন্য দলের বিড়ম্বনার শেষ নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী হিংসার মামলায় রাজ্য সরকার নাস্তানাবুদ হচ্ছে আদালতে। সেই হিংসায় জড়িয়েছিল ভাঙড়ের আরাবুলের নাম। এখন লোকসভা ভোটের মুখে শাহজাহানের কীর্তিতে আতান্তরে পড়েছে সরকার। শাসকদল তৃণমূলও। সন্দেশখালিকে প্রচারে এনে আসন্ন নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার পরিকল্পনা ছকেছে বিজেপি। খালিস্তানি মন্তব্যে বিজেপি কিছুটা লুজ বল খেলায় তাই সুযোগটা লুফে নিয়েছেন ঝানু রাজনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি জানেন, রাজনীতির কোন বল কীভাবে খেলতে হয়। শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর চারপাশের ভিড় থেকে কেউ একটা খালিস্তানি মন্তব্য করেছিলেন নিশ্চয়ই। যেটা অনভিপ্রেত। যদিও সেটাই মমতার কাছে হয়ে উঠেছে অস্বস্তি এড়ানোর অস্ত্র। শুভেন্দু এখন কট্টর তৃণমূল বিরোধী। অথচ তিনি আর মুকুল রায় একসময় ছিলেন মমতার সম্পদ। সেই সম্পদ এখন হয়ে উঠেছেন গদ্দার। মুকুলকেও কিছুদিন গদ্দার বলা হত।
তৃণমূলের পতাকা গলায় জড়িয়ে সেই কলঙ্কমোচন করে অতীতে তৃণমূলের নম্বর টু নেতা এখন অন্তরালে। এ রকম অনেক সম্পদ আর গদ্দার রাজনীতিতে ছড়িয়ে আছেন। প্রায় সব দলে। শাহজাহান অনেকদিন পর মনে করালেন বাম জমানার ক্যালসা মিয়াঁকে। ২০০৩-এ কোচবিহারের ঘোকসাডাঙ্গায় এক গণধর্ষণে প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন সিপিএম নেতা সমিরুদ্দিন (ক্যালসা মিয়াঁ নামে যাঁর পরিচিতি)। তাঁকে দলের সম্পদ বলে দাবি করেছিলেন সিপিএমের তৎকালীন মন্ত্রী দীনেশ ডাকুয়া।
সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস গণধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে নির্যাতিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। শেষ রক্ষা করতে পারেননি। সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে ক্যালসা মিয়াঁর দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সেদিন ওই গণধর্ষণের প্রতিবাদে কোচবিহারে আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়েছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাগ্যের থুড়ি, ক্ষমতার এমন পরিহাস যে, সেই মমতার রাজত্বে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠছে এখানে-সেখানে।
কখন যে কে দলের সম্পদ বা গদ্দার হয়ে যায়। দল ক্ষমতায় থাকলে ক্যালসা মিয়াঁ, আরাবুল, শাহজাহানদের সংখ্যা বাড়ে। বাম জমানায় ক্যালসা থেকে মজিদ মাস্টার কিংবা হুব্বা শ্যামল, সম্পদ কম ছিল না। এখন যেমন শিলিগুড়িতে অনেক সম্পদের দেখা মিলছে। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের সংগঠন গড়ে তোলার প্রথম দিকের অগ্রণী সৈনিক স্বপন দাসের জমিতে বাড়ি তৈরিতে বাধা দিয়েছে দলীয় কাউন্সিলারের লোকজনই।
যাদের নেতৃত্বে কাউন্সিলারের স্বামী বিবেকানন্দ সাহা। ওই জমিতে তিনি দলবল নিয়ে ঝান্ডা পুঁতে দিয়েছেন। প্রবীণ স্বপনবাবু নালিশ জানিয়েছিলেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবকে। তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভানেত্রী (সমতল) পাপিয়া ঘোষ তিরস্কার করেছেন অভিযুক্তদের। কিন্তু এতই প্রতাপ যে, বিবেকানন্দদের পোঁতা ঝান্ডা এখনও খোলাতে পারেননি গৌতম, পাপিয়ারা। স্বপনও নিজের জমিতে বাড়ি বানাতে পারছেন না। দলের সম্পদ বলেই অন্যায় করে পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা। নেতাদের হিম্মত নেই তাঁদের টিকি ছোঁয়ার।
আলিপুরদুয়ার জেলায় তৃণমূলের রদবদলে ১ নম্বর ব্লকের সভাপতির পদ থেকে বাদ পড়েছেন পীযূষকান্তি রায়। সাতের দশক থেকে রাজনীতি করছেন। এতদিনের সম্পদ হঠাৎ হয়ে গেলেন চক্ষুশূল। কেন? পিছনে সেই ‘সম্পদ’ তত্ত্ব। কাজ ফুরোলে সম্পদ দলের ডাস্টবিনে চলে যেতে পারে। নতুন সম্পদ এসে গিয়েছে। জেলা সভাপতির পছন্দ-অপছন্দে সম্পদ বা গদ্দার চিহ্নিত হচ্ছে।
নিজের রক্ত-ঘাম ও পকেটের টাকায় কোচবিহার জেলায় তৃণমূল গড়ে তোলায় অবদান ছিল রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। দলে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জেলা সভাপতি। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার অনেক আগে রাজ্য কমিটির কোষাধ্যক্ষের পদ সামলেছেন ব্যক্তিগতভাবে অর্থ জুগিয়ে। সাংগঠনিকভাবে পায়ের তলায় কিছু জমি আছে বলে রাজনীতিতে রয়ে গিয়েছেন এখনও। নাহলে হয়তো স্থান হত বাতিলের খাতায়। পুরসভার চেয়ারম্যান পদ পেয়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচিয়ে চলছেন।
গদ্দার না বলুক, রবীন্দ্রনাথকে দলের সম্পদের স্বীকৃতি এখন আর দেয় না কেউ। মালদার কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ও সাবিত্রী মিত্রের একই দশা। কৃষ্ণেন্দুও পুরসভার চেয়ারম্যান হয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছেন। সাবিত্রীর সেই ভাগ্য হয়নি। নতুন সম্পদ তাঁরাই, এমনকি স্থানীয় নেতাদেরও যাঁরা পাত্তা দেন না।
শিলিগুড়ির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে পূর্ত দপ্তরের জমিতে বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে। জমিতে পুরনিগমের রাখা ভ্যাট পর্যন্ত রাতারাতি হাওয়া করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওয়ার্ডের নেতা সৌমিত্র দেবনাথের বিরুদ্ধে। বিষয়টি প্রশাসনের, দলের নয় বলছেন তৃণমূলের জেলা সভানেত্রী পাপিয়া ঘোষ। দল যে এমন ‘সম্পদ’দের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে না, শিলিগুড়ির এই ঘটনাটি তার বড় প্রমাণ। সম্পদদের আগলে রাখা হয় বলেই না পুলিশ হদিস জানলেও শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করতে গড়িমসি করে।