- নীলাদ্রি দেব
রাজনগর কোচবিহারকে সংক্ষিপ্তভাবে সিওবি লিখি। সিটি অফ বিউটি। ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকা শহরটি সম্প্রতি হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠছে পথঘাট, ইতিহাসের ইমারত, স্থাপত্য ইত্যাদি। বিপ্রতীপে কেউ অবশ্য বলছেন, সেজে হেরিটেজ হয়ে ওঠা যায় নাকি! কিন্তু সম্পৃক্ত সবটার রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সুন্দর উপস্থাপনায় তুলে ধরতে যে প্রচেষ্টা, তাতে সামগ্রিক ইতিহাস আরও বেশি আগ্রহী চোখে ও চর্চায় উঠে আসতে পারে। পর্যটনের আকর এই উত্তরে বরাবরের গুরুত্বপূর্ণ কোচবিহার। প্রায় সব জনপদের মতোই শহরটির নকশা বিবর্তনে বদলে গিয়েছে, যাচ্ছে। আর সুন্দর? যদিও সুন্দরের সংজ্ঞা মানুষ থেকে মানুষে ভিন্ন, তবু আরও সুন্দরের ছবি তো হেঁটে চলে বেড়ায় বন্ধ চোখের সামনে।
ইতিহাস ও বর্তমানকে এক অক্ষে প্লট করলে দেখা যায় কোচবিহার অত্যন্ত পরিকল্পিত একটি নগর। প্রতিটি বাড়ির নিজস্বতা থাকলেও কোথাও গিয়ে একটি সামগ্রিক ধরন গড়ে উঠেছিল। অসামান্য সংগ্রহের গ্রন্থাগার ছিল, যার তুলনা সে নিজেই। ছিল সৌন্দর্যের বোধ ও চর্চা। আর ছিলেন সম্প্রীতির চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে থাকা সহজ যাপনের মানুষরা।
এখন রাস্তায় খুব সহজে হাঁটা যায় না। আর শহরে পার্কিং স্পেসের বড় অভাব। অধিক যানবাহনে শিশু কিংবা বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি অসুবিধের মুখোমুখি হন। আসলে জনবিস্ফোরণের ফল বিভিন্ন দিকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিকাশিনালা, ঢালহীন একটি বদ্ধ জলাধার ছাড়া এদের কীই বা বলা যেতে পারে! কোচবিহারের পুরোনো ঘরবাড়িগুলোর শৈলী দেখতে এখন হাতেগোনা কিছু বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতে হয়। বাকি সব পোশাক বদলে ফেলেছে। বড় বড় অট্টালিকাগুলোর নির্দিষ্ট প্রকার চরিত্র গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার সেকাল ও একাল মিশে গিয়েছে। অনন্ত সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ গ্রন্থাগারগুলো দৃশ্যত রুগ্ন। দিঘি, যা কিছু বেঁচে আছে, আশা রাখি আগামী প্রজন্ম নিজেদের স্বার্থেই তাদের ভালো রাখবে। একই কথা সবুজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। তোর্ষা ক্রমে দেহশূন্য একটি নামে পরিণত হবে কি না, তা নতুন প্রশ্ন নয়।
এখন কোচবিহার থেকে বিমান, ট্রেন, বাস সবটাই দূরপাল্লার জন্য সক্রিয়, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট কম। প্রাণকেন্দ্র সাগরদিঘিকে ঘিরে সৌন্দর্যায়নের যে বিবর্তন, তার ধাপগুলো বিভিন্ন প্রজন্ম বিভিন্নভাবেই উপভোগ করেন। শহরে বিচ্ছিন্নভাবে মনীষীদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা পেলেও, নির্দিষ্ট স্থানে স্ট্যাচু পার্ক গড়ে তুলে একই ক্ষেত্রফলে তাঁদের শ্রদ্ধা ও স্মরণের স্পেস গড়ে তোলা যেত। আর্ট গ্যালারি, আর্ট কলেজ এ শহরে গড়ে ওঠেনি। বিকল্পধারার নাট্যচর্চা কেন্দ্রও না। লোকসংস্কৃতির আকর, অথচ তেমন সংগ্রহশালা নেই, নেই স্থানিক ইতিহাসেরও। সাহিত্যের এতটা প্রবাহ, অথচ মত বিনিময়ের স্পেস নেই। বাজার গড়ে ওঠেনি বলে বইবিপণি হাতেগোনা।
ক’দিন আগে শীতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম নদীচরের দিকে। গাঢ় হয়ে আসে। দেখি আগুনকে ঘিরে বৃত্ত হয়ে আছে মানুষ ও পশুর সহাবস্থান। দ্বিতল বাসের ছাদে উঠে গান ছড়িয়ে দিই সমস্ত ভূগোলে। পাওয়া আর না পাওয়ার পাল্লাপাথর ওঠা-নামা করে। স্বপ্নের বা চাহিদার সবটা পূর্ণ হলে নিশ্চয়ই আরও ভালো হত। এ ভালোর শেষ নেই। এতটা আছে বলেই তো আরও কিছু আশা জেগে থাকে।
(লেখক কোচবিহারের বাসিন্দা। সাহিত্যিক)