অনসূয়া চৌধুরী, জলপাইগুড়ি: একটা সময় ছিল, যখন মানুষের মননশীলচর্চার একমাত্র পীঠস্থান ছিল এলাকার গ্রন্থাগারগুলি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, গল্প-উপন্যাস, ভ্রমণ, সাহিত্য থেকে শুরু করে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিপুল সম্ভারে ঠাসা থাকত গ্রন্থাগারের (Library) প্রতিটি বুকশেলফ। স্কুল-কলেজের পড়ুয়া ও গবেষকরাতো যেতই, এলাকার প্রবীণরাও অবসর বিনোদনের জন্য গ্রন্থাগারেই আস্থা রাখতেন। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে তাঁরা খুঁজে নিতেন যাপিত জীবনের চাওয়াপাওয়া, আশানিরাশার গল্প। শিশুদের জন্যও ছিল আলাদা বিভাগ। বিভিন্ন মনীষীর জীবনী, ভৌতিক গল্প কী ছিল না সেখানে। কল্পবিজ্ঞানের এক স্বপ্নময়জগতে অবাধ বিচরণ ছিল তাঁদের। স্বাভাবিকভাবেই লাইব্রেরিগুলি একসময় বিভিন্ন বয়সের পাঠকের ভিড়ে জমজমাট হয়ে থাকত।
সময় বদলেছে। প্রযুক্তির অশ্বমেধ ঘোড়া ফোর-জি থেকে ফাইভ-জির দুনিয়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। মুঠোফোনের এক একটি ক্লিকেই খুলে যাচ্ছে বিনোদনের ভিন্ন ভিন্ন জগৎ। এর ফলেই ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরিগুলি। এখন লাইব্রেরিতে আর আগের মতো পাঠকের ভিড় নেই। সাহিত্যপ্রেমীদের হাতের স্পর্শ না পেয়ে গল্প-উপন্যাসের বইগুলি ধুলো জমে জমে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। একই হাল জলপাইগুড়ি শহরের লাইব্রেরিগুলিরও।
ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছর আগে গড়ে উঠেছিল শহরের আজাদ হিন্দ পাঠাগার। দীর্ঘ পথ চলা এই গ্রন্থাগারে পাঠকের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন বই নিতে সপ্তাহে ৫-৬ জন মাত্র আসেন। বিকেলের দিকে একটু ঢুঁ মেরে যান অবসরপ্রাপ্তরা। দু’-একজন গবেষক এখনও মাঝেমধ্যে বইয়ের খোঁজে আসেন। জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগারের ছবিটাও প্রায় একইরকম। চাকরির পরীক্ষার বই খুঁজতে কেউ কেউ এলেও উপন্যাস, গল্প, নাটক পড়ার মতো পাঠক আর নেই বললেই চলে।
১৯৪৪ সালে গড়ে ওঠা শহরের বাবুপাড়া পাঠাগারে একসময় হুমায়ুন কবীর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ স্যানাল, সমরেশ মজুমদারদের মতো সাহিত্যিকদের আনাগোনা ছিল। এখন সেই গ্রন্থাগারও প্রায় পাঠকশূন্য হয়ে পড়েছে। পাঠাগারের সহকারী সচিব তপনকুমার ঘোষ বলেন, ‘মেম্বারশিপ (Membership) ছাড়াও যদি কোনও পাঠক আসেন তাও ভালো লাগে। আগে মেম্বারশিপ নেওয়ার জন্য লড়াই হত। এখন সবই অতীত।’
লাইব্রেরিগুলিতে পাঠক না আসার পেছনে প্রায় সকলেই দায়ী করছেন বর্তমান ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এর আরও একটি কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। সাহিত্য পড়ার মতো আর সময় নেই তরুণ-তরুণীদের। সেই কারণেই পাঠকের স্বাদ অনুয়ায়ী বইমেলাগুলো থেকে গল্প, উপন্যাসের বই না কিনে পাঠাগারগুলিতে চাকরির পরীক্ষার বইপত্র সংগ্রহ করা হয়৷ তবুও পাঠকের দেখা নেই কেন? এর উত্তরে কলেজ পড়ুয়া তথাগত ঘোষের দাবি, ‘লাইব্রেরি গিয়ে উত্তর খুঁজতে যত সময় লাগে, তার থেকে ইন্টারনেটে খোঁজা অনেক সহজ। তাই স্কুল থেকে বের হওয়ার পর আর লাইব্রেরিমুখো হইনি।’