শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি, ২৩ ডিসেম্বর: বরাবরের ভালো ছাত্র। যে কোন পরীক্ষায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নম্বর যার বাধা ছিল, সে নাকি ফলাফল নিয়ে চিন্তায় নিজেকে শেষ করে দিল! পরিবারের দাবি অন্তত সে রকমই। ফাঁকা বাড়িতে শুক্রবার টিনের চালার তলায় মায়ের ওড়না গলায় জড়িয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে ১৬ বছরের কিশোরকে। শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের ওই ছাত্রের নাম সৌনভ দে। শুক্রবার দুপুরে আত্মীয়রা খোঁজ করতে গিয়ে মৃত অবস্থায় দেখতে পায় তাকে।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ছিল শুক্রবার। মৃতদেহ উদ্ধারের পর ফল প্রকাশ হলে জানা যায়, ভালো ফলই করেছে সে। ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৪৩৮ নম্বর পেয়ে নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। অথচ সৌনভের কাকিমা সোমা দে সকালে শুনেছেন, ‘বাড়ির সামনে মোবাইলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলার সময় ও বারবার চিন্তায় আছি বলছিল।’ কী নিয়ে চিন্তা, সেটা তখন কাকিমা বোঝেননি।
এদিন দেহ ঝুলতে দেখে আত্মীয়রা মনে করছেন, সৌনভ ফলাফল নিয়ে চিন্তায় ছিল। সেই উদ্বেগে সে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। সৌনভের বাড়ি শিলিগুড়ির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে দক্ষিণ ভারতনগরে। তার মৃত্যুতে হতবাক শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের শিক্ষকরাও। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল দত্ত বলেন, ‘কার চিন্তাভাবনা কী, সেটা বোঝা মুশকিল। ক্লাসে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে নম্বর থাকত সৌনভের। রেজাল্টে কোথাও কোনও সমস্যা ছিল না। তারপরেও কেন এ রকম করল কে জানে।’
অন্য কোন অভিযোগ না থাকায় পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে। কিন্তু বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, সৌনভ যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে তার কারণ কী? সকাল থেকে তার স্বাভাবিক আচরণই দেখেছেন আত্মীয়রা। রোজ স্নানের সময় গান গাইত। ওর কাকিমা সোমা জানালেন, শুক্রবারও স্নান করার সময় সৌনভকে গান গাইতে শুনেছেন তিনি।
বছর দুয়েক আগে করোনাকালে সৌনভের বাবার মৃত্যু হয়। তারপর থেকে বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সে থাকত। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। বাবার মৃত্যুর পর সৌনভের মা কৃষ্ণা দে পেট্রোল পাম্পে তেল ভরার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ফলে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন তিনি। শুক্রবারও তাই হয়েছিল। শুক্রবার তাড়াহুড়ো থাকায় কৃষ্ণাদেবী বলে গিয়েছিলেন, সৌনভ স্কুলে যাওয়ার আগে ওর ঠাম্মার খাবার দিয়ে যাবে। কিন্তু বেলা ১২টা বেজে গেলেও খাবার না দেওয়ায় খোঁজ করতে যান ওর কাকা দেবু। তাঁর কথায়, ‘শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখি, সৌনভ নেই। পাশ ফিরতেই ওর পা গায়ে লাগে। ঘুরে দেখি, টিনের শেডে লাগানো লোহার কাঠামো থেকে গলায় ওড়না লাগিয়ে ঝুলে রয়েছে সৌনভ।’
সৌনভের কাকিমা সোমা দে জানিয়েছেন, ‘ও ঠাম্মার জন্য খাবার দিতে না আসায় আমি ওর বাড়ির দরজায় ঠকঠক করি। ওর কানে হেডফোন ব্যবহারের অভ্যাস ছিল। তাই স্বামীকে গিয়ে বলি, ভেতরে গিয়ে দেখতে।’ এরপর কাকা কী গিয়ে ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘জানি না, কোথা থেকে কী হয়ে গেল।’ সৌনভের কাকিমা জানিয়েছেন, পরিবার থেকে কোনওদিন পড়াশোনা চাপ দেওয়া হত না ওকে।
তবে শিলিগুড়ি বয়েজের ওই নবম শ্রেণির ছাত্রের নিজেরই আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কাকিমা জানিয়েছেন, অঙ্কে একটু দূর্বল থাকায় সেদিকে নজর দিতে শুরু করেছিল কিশোরটি। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে দেহ প্রথমে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে ময়নাতদন্তের জন্য দেহ নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে। সৌনভের মৃত্যুতে এলাকায় ও স্কুলে শোকের ছায়া নেমেছে।