Monday, May 20, 2024
HomeMust-Read Newsফিল্ম সিটির প্রতিশ্রুতি আজও আঁধারে

ফিল্ম সিটির প্রতিশ্রুতি আজও আঁধারে

  • দীপ সাহা

আচ্ছা, কতগুলো শূন্য পড়লে হাজার কোটি হয় বলুন তো! না, মানে এখনকার শিল্প সম্মেলনগুলোয় বিনিয়োগের বার্তা শুনলে অবুঝ মন এই প্রশ্নটা করে ফেলে আর কি।

এই তো মাসখানেক আগের কথা। মুখ্যমন্ত্রীর শেষ উত্তরবঙ্গ সফরকালেই বাণিজ্য সম্মেলন হল শিলিগুড়িতে। কাওয়াখালির শিল্পী হাটে দাঁড়িয়ে রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী ঘোষণা করে গেলেন, ২৪ হাজার কোটি বিনিয়োগ আসছে উত্তর বাংলায়। জাস্ট ভাবুন একবার! চব্বিশ হাজার কোটি! তা কী প্রস্তাব এল সেখানে? ওই সেই গতে বাঁধা ইথানল কারখানা, দু’-চারটে রিসর্ট, বেসরকারি হাসপাতাল ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এত সম্ভাবনাময় এলাকায় কেউ একটিবার বললেন না ফিল্ম সিটির কথা। এতগুলো বছরেও। আক্ষেপটা এখানেই।

ঠিক ছয় বছর আগে এই আক্ষেপটাই শুনেছিলাম ইন্ডাস্ট্রির ‘ওয়ান অ্যান্ড ওনলি’ বুম্বাদার মুখে। শিলিগুড়িতে বসে একান্ত আলাপচারিতায় উত্তরে ফিল্ম সিটি গড়া নিয়ে তাঁর লেগে থাকা এবং হতাশ হওয়ার কাহিনী শুনিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কিছুদিন আগে বর্তমান বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ও মালবাজারে এসে সওয়াল করেছেন উত্তরে ফিল্ম সিটি গড়ার ব্যাপারে। একটা নয়, একাধিক ফিল্ম সিটি হতে পারে বলে তাঁর মত।

হবে নাই বা কেন! কী নেই উত্তরে? ঘন সবুজ জঙ্গল, বিস্তৃত পাহাড়, দু’কূল ছাপানো নদী- প্রকৃতি যেন উদার এখানে। এমন সৌন্দর্যের মেলবন্ধন বাংলায় আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। তাইতো সাগিনা মাহাতো হোক বা হালের বাংলা সিনেমা প্রধান- উত্তরের টানে বারবার ছুটে এসেছেন পরিচালকরা। আসছেনও। আগের চাইতে কাজের পরিসরও বেড়েছে অনেক। কত মানুষ আসতে শুরু করেছেন নতুন নতুন পেশায়। অথচ ভাবুন, এখানে ইন্ডোর শুটিংয়ের জন্য এক ছাতার তলায় একটা পরিকাঠামো গড়ে তোলা গেল না। না সরকার পারল, না কোনও শিল্পপতি।

চেষ্টাটা হয়েছিল বাম আমলের শেষদিকে। ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের চালসায় ফিল্ম সিটি গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল একটি চিটফান্ড গোষ্ঠী। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডলিউড’। বলিউড ও টলিউডের তাবড় তারকাদের সামনে রেখে শুরু হয়েছিল প্রচার। কিন্তু তারপরই রাজ্যে পালাবদল এবং চিটফান্ডের কেচ্ছা প্রকাশ্যে আসে। অগত্যা প্রকল্পটির সলিলসমাধি। রাজ্যে ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও দুটি ফিল্ম সিটি গড়তে চেয়েছিল। একটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরে, আরেকটি শিলিগুড়ি শহর সংলগ্ন কাওয়াখালিতে। কিন্তু আক্ষেপের কথা, উত্তরের ফিল্ম সিটির জন্য একমাত্র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ টেন্ডারে সাড়াই দেননি। ভেস্তে যায় গোটা পরিকল্পনা। তারপর এই উত্তরবঙ্গ থেকে গৌতম দেব, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, উদয়ন গুহ, সাবিনা ইয়াসমিন, গোলাম রব্বানি, বাচ্চু হাঁসদারা মন্ত্রী হয়েছেন। গৌতম দেব দু’একবার মুখ ফুটে বললেও বাকি কেউ ফিল্ম সিটি গড়া নিয়ে কোনওদিনও টুঁ শব্দটি করেননি।

অথচ দেখুন, হায়দরাবাদে কীভাবে রামোজি ফিল্ম সিটি আর পর্যটন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। একই ছবি দেখতে পাবেন চেন্নাইয়ের এমজিআর, নয়ডা ও বেঙ্গালুরুর ফিল্ম সিটিতে। এমনটা তো হতে পারত উত্তরেও। পর্যটন আর সিনেমাকে মিলিয়ে দেওয়া যেত নিমেষেই। কিন্তু তা বোঝার ক্ষমতা বোধহয় এখানকার নেতাদের নেই। তাই তাঁরা শিল্পপতিদেরও বোঝাতে পারেন না।

উত্তরের সিনেমা কলাকুশলীদের একটি সংগঠন একসময় বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছে ফিল্ম সিটি তৈরির জন্য। সেই সংগঠনেরই এক কর্মকর্তার গলায় এখন হতাশা, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ আর কতদিন তাড়াব। নেতাদের কাছে গিয়েও আর কোনও লাভ হয় না।’

ওয়েব সিরিজের জমানা শুরুর পর থেকেই শুটিং পার্টির ভিড় বেড়েছে উত্তরে। বাইরে থেকে শুটিং দল এসে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস শুটিং করে যাচ্ছে। অথচ তাতে কানাকড়িও লাভ হচ্ছে না সরকারের। বেসরকারি ক্ষেত্রেও আয়টা সামান্য। ওই হোটেল, রেস্তোরাঁগুলোর খানিক লাভ হচ্ছে শুধু। কিন্তু ফিল্ম সিটি হলে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে যেমন আয় বাড়তে পারত, তেমনই সুবিধা হত শুটিং দলের। দিনে আউটডোর শুটিং করে রাতে ইন্ডোর শুটিং সম্ভব হত। ফলে প্রযোজকদের সময় ও অর্থ দুই-ই বাঁচত।

শুধু বাইরের নয়, উত্তরের প্রযোজক-পরিচালকরাও কিন্তু এতে লাভের মুখ দেখতে পারতেন। এখন তো মালদার গাজোল থেকে শুরু করে কোচবিহারের প্রত্যন্ত মেখলিগঞ্জ- পরিচালকের ছড়াছড়ি। মূলধারার ইন্ডাস্ট্রিতেও চলে এসেছেন কয়েকজন। সেইসঙ্গে বাড়ছে কলাকুশলীর সংখ্যাও। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড টেকনিসিয়ান, ভিডিও এডিটর, মেকআপ আর্টিস্ট আরও কত কী! এই উত্তরে যদি ফিল্ম সিটি গড়া যেত তাহলে একদিকে যেমন শুটিং দলকে বাইরে থেকে কলাকুশলী আনতে হত না, তেমনই এখানকার ছেলেমেয়েরাও কাজ পেত। অর্থাৎ কর্মসংস্থান ও অর্থলাভ দুই-ই সম্ভব ছিল।

অতিসম্প্রতি শিলিগুড়ির ছেলে অভিজিৎ শ্রীদাস পরিচালিত বিজয়ার পরে মুক্তি পেয়েছে বাংলায়। মমতাশংকর, স্বস্তিকা, মীর, দীপঙ্কর দে অভিনীত ছবিটির প্রযোজক সুজিত রাহাও শিলিগুড়ির। আক্ষেপ শুনেছি তাঁদের গলাতেও। শুধু পরিকাঠামোর অভাবে অভিজিৎদের শুটিংয়ের জন্য ছুটতে হয়েছিল কলকাতায়।

কথা হচ্ছিল উত্তরের এক নামী লাইন প্রোডিউসারের সঙ্গে। একটি ওটিটির ওয়েব সিরিজের শুটিংয়ের জন্য মাস কয়েক আগে দেড়শোজনের একটি দল এসেছিল উত্তরবঙ্গে। কিন্তু টেকনিকাল কিছু সমস্যার কারণে তখন আউটডোর শুট করা সম্ভব হয়নি। তাই সময় নষ্ট না করে ইন্ডোর শুটিংয়ের খোঁজখবর চলছিল। কিন্তু সেই পরিকাঠামো মেলেনি উত্তরে। বাধ্য হয় দলটিকে ফিরে যেতে হয় মুম্বইয়ে। এমন উদাহরণ হয়তো আরও অনেক আছে।

আজকাল বাংলায় যতগুলো শিল্প সম্মেলন হয়, আর যত টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব আসে তার কতটা বাস্তবে কাজে লাগে বোঝা যায় না। বলা ভালো, চোখে দেখা যায় না। সবথেকে বড় কথা, শিল্পপতিরা নতুন করে কিছু ভাবেন না। তাইতো তাঁদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ও শিল্পপতিবাবুরা, এবার একটু ভাবুন। অন্তত ভাবাটা প্র্যাকটিস করুন।’

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Ebrahim Raisi। ইরানের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ভেঙে পড়ল কপ্টার, খারাপ আবহাওয়ায় বিঘ্নিত উদ্ধারকার্য

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ফেরার পথে দূর্ঘটনার কবলে পড়ল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টার। কপ্টারে তাঁর সঙ্গে ইরানের বিদেশমন্ত্রীও ছিলেন বলে...

Money seized | হাওয়ালা ব্যবসায়ীদের ডেরায় হানা বিহার পুলিশের, নেপাল সীমান্ত রকসলে উদ্ধার ৯৪...

0
কিশনগঞ্জঃ নির্বাচনের মাঝেই ফের লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি টাকা উদ্ধার করল বিহার পুলিশ। রবিবার এই বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার হয় ইন্দো-নেপাল সীমান্ত পূর্ব চম্পারণ জেলার...

Cooch Behar | অক্সফোর্ডে সাফল্য কোচবিহারের মেয়ের, খুশির হাওয়া জেলাজুড়ে

0
কোচবিহার: এবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও সাফল্যের চিহ্ন রাখল কোচবিহার। শনিবার বিশ্বসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজের এমফিল ডিগ্রি গ্রহন করলেন কোচবিহারের মেয়ে মৌমিলি...

Belacoba | রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ, প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ গ্রামবাসীদের   

0
বেলাকোবাঃ রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের কাজের অভিযোগে সরব হলেন গ্রামবাসীরা। ঘটনাটি জলপাইগুড়ির সদর ব্লকের বেলাকোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের। জানা গিয়েছে, বেলাকোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের সর্দার পাড়ায় ৯...

Raiganj | ত্রিপুরার ব্যবসায়ী খুন কাণ্ড, রায়গঞ্জ থেকে ধৃত মূল পাণ্ডা

0
রায়গঞ্জ: অবশেষে ধরা পড়ল ত্রিপুরার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী দুর্গাপ্রসন্ন দেব খুনের মূল পাণ্ডা রাকেশ বর্মন (৩৩)। রায়গঞ্জ থানা ও ত্রিপুরা পুলিশের যৌথ অভিযানে রায়গঞ্জ শহরের...

Most Popular