- অজিত ঘোষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘বাঁশি’ কবিতায় ধলেশ্বরী নদী চিত্রিত হয়েছে৷ কবিতার নায়ক হরি কেরানির জীবনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে করতে কখন যেন ধলেশ্বরী নদী এসে মিশেছে আমার ঘরের নদী পুনর্ভবায়৷ মানুষের এই এক বিচিত্র মতি৷ দরদি মানুষের চোখ আর শান্ত নদী দেখলেই নিকট আত্মীয় বুঝে যায়৷
নদীভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম নদী পুনর্ভবা এমন এক নদী, যা মৌর্য-গুপ্ত-পাল-কুষাণ যুগের ইতিহাসের সাক্ষ্য বুকে বহন করে চলেছে৷ পাল রাজাদের সময়ে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী নদী পুনর্ভবা৷ পুনর্ভবা সেসময় ‘কাঞ্চন’ নামে পরিচিত ছিল৷ প্রথম হিন্দু রাজা গণেশ রাজধানী গড়েন এই নদীর তীরে৷ এই নদীর ধারেই গড়ে উঠেছিল বাণগড় সভ্যতা৷ শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ নদী পাড়ি দিয়ে এসেছিল বাণরাজ-কন্যা ঊষাকে হরণ করতে৷ পাণ্ডবরা এক বছর অজ্ঞাতবাসের সময়ে এই নদী সাঁতরেই এসেছিল বাণরাজার পূর্বপুরুষ বিরাটরাজার দরবারে৷ বক্তিয়ার খলজির সমাধি আজও বর্তমান পুনর্ভবা নদীতীরের পীরপাল গ্রামে৷
‘পুনঃ পুনঃ ভবা’ অর্থাৎ বারবার গতিপথ বদলে নদীর নাম হয়েছে পুনর্ভবা৷ একদিকে তাম্রলিপ্ত, অন্যদিকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নদীপথে চলত ব্যবসাবাণিজ্য৷ দেবী চৌধুরানির ‘বজরা’ নাকি এই নদীতেই পাল তুলে ছুটে বেরিয়েছে৷ ষাটের দশকেও ভরা যৌবনা ছিল৷
এখন সেসব অতীত৷ ভালো নেই নদীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষজন৷ হালদারপাড়ার দীপু হালদার পুনর্ভবার বুকে নৌকো ভাসিয়ে সংবৎসর মাছ ধরতেন৷ মাছ বিক্রি করতেন নিউমার্কেটের বাজারে৷ এখন ভিনদেশি শ্রমিক৷ একই অবস্থা অর্জুন বর্মন, সিদ্ধেশ্বর হালদারের মতো অনেক মৎস্যজীবীর৷ নদীর জলকে সেচের মাধ্যমে কৃষিতে ব্যবহার করে একফসলি জমিকে তিনফসলিতে পরিবর্তিত করতে দেখা যেত সুকদেবপুর, জয়পুর, কাঁটাবাড়ি, করদহ, বাসরের অনেক কৃষককে৷ বছরে এখন একটি ফসলই যেন ভবিতব্য৷ ফলত কৃষিকাজ ছেড়ে টোটোচালক বা ফেরি ব্যবসায় যুক্ত অনেক কৃষক৷
জলের অভাবে আশির দশক থেকেই যেন বার্ধক্যে পৌঁছে যায় নদী৷ ২২৩ কিলোমিটারের বিস্তৃত নদী ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে৷ শিববাড়ির কেশবপুরে নদী দিগন্ত বিস্তৃত চড়া৷ বারুণীমেলায় পুণ্যার্থীদের ভরসা এখন ঘটি৷ পৌষ সংক্রান্তির পুণ্যস্নান এখন জলের অভাবে বিরল দৃশ্য৷ বিলুপ্ত হয়ে চলেছে ভ্যাদা, তিনকাটা, বউ, খয়রার মতো নদীয়ালি মাছের প্রজাতি৷
নদীচুরি চলছে অনবরত৷ নদীর বুকে চলছে অবৈধ নির্মাণ৷ ড্রেজিং না হওয়ায় কমেছে নাব্যতা৷ এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুনর্ভবার আন্তর্জাতিক সমস্যা৷ বাংলাদেশে আত্রেয়ী নদীর ক্ষেত্রে যেভাবে সরাসরি বাধা দেওয়া হয়েছে, পুনর্ভবার ক্ষেত্রে তা হয়নি৷ ঢাকা-দিনাজপুর রোডে বীরগঞ্জের কাছে লকগেট তৈরি করে টেপা নদীর (দীপা নদী) জলকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যে নদীর জল পুষ্ট করত পুনর্ভবাকে৷
প্রচলিত মিথ অনুসারে স্বর্গের অপ্সরা অভিশাপে বালিকা রূপে জন্মেছিল মর্তে৷ রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে, পুনর্ভবা নদীরূপে বইতে শুরু করে৷ সেই পুনর্ভবার বুকে কান পাতলে শোনা যায় কান্না৷ ক্রমশ যেন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে পুনর্ভবা৷ এমনই কান্না শোনা যেত তিস্তার৷ প্রশ্ন জাগে, পুনর্ভবা কি পারবে? প্রতিশোধস্পৃহা কি সবার মধ্যে থাকে? সবাই কি সব পারে? না পারলে পুনর্ভবার মৃত উপনদী ঘাঘরা, গাবুরা, কাঁচাইয়ের মতো একসময় পুনর্ভবাও মৃত নদীতে পরিণত হবে৷
(লেখক গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা। সাহিত্যিক)