দেওয়ানহাট: ‘আমি ভালো আছি বাবা। বাড়িতে তোরা চিন্তা করিস না। কালকের মধ্যেই আমরা বেড়িয়ে আসব।’ বৃহস্পতিবার রাত দশটা নাগাদ ফোনে মানিক তালুকদারের এই কথাগুলি শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন ছেলে মণি। পাশে বসা স্ত্রী সোমা, অন্যান্য আত্মীয়দের চোখেও তখন জল। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারায় ১২ দিন থেকে সুড়ঙ্গে আটক প্রিয়জনের মুখের কথা তখন সকলের কাছেই এক বিরাট প্রাপ্তি। ধারাবাহিক উদ্বেগ, উৎকন্ঠার মাঝে এক নতুন আলোর উদ্ভাস। কিন্তু রাত ফুরিয়ে শুক্রবার বেলা বাড়তেই তা ফের ফিঁকে হতে শুরু করল। অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেও এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সুড়ঙ্গ থেকে মানিক সহ অপর শ্রমিকদের উদ্ধারের কোনও খবর মেলেনি। শনিবারও কী কাটাতে হবে সেই অপেক্ষার প্রহর, জানা নেই তাঁর পরিবারের।
গত ১১ নভেম্বর রাতে উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারায় সুড়ঙ্গ ভেঙে ভিতরেই আটকে পড়েন মানিক তালুকদার সহ মোট ৪১ জন শ্রমিক। যার দরুন তুফানগঞ্জ-১ ব্লকের বলরামপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের চেকাডরা গেরগেন্দারপাড় এলাকায় তালুকদার বাড়ি ভরে ওঠে গভীর উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায়। প্রিয়জন ফের সুস্হভাবে ফিরে আসবেন তো, এই ভাবনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তাঁর স্ত্রী, সন্তান সহ আত্মীয়রা। কিন্তু গত কয়েকদিনে মাঝেমধ্যেই উদ্ধারকারী দলের আশ্বাসবাণীতে তাঁরা কিছুটা ভরসা পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে মানিকের পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত দুই আত্মীয় বিনয় তালুকদার ও গৌতম চন্দ জানিয়েছেন, ‘কাঙ্খিত মুহূর্ত আসতে আর বেশি দেরি নেই।’ কিন্তু শুক্রবার বেলা যত গড়িয়েছে তালুকদার বাড়ির পরিবেশ হয়েছে তত ভারী। গোটা গ্রামেও যেন একটা মন খারাপের আবহ।
এরমধ্যেই শনিবার সাঁঝবেলায় গ্রামের খুদেরা মানিকের মঙ্গল কামনায় সমবেতভাবে গোপাল ঠাকুরের পুজোর আয়োজন করে। শৈশবের সারল্যে সেই পুজোয় প্রসাদ হিসেবে ছিল নানারকম চকোলেট। খুদেদের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া দীপাঞ্জনা রায় সম্পর্কে মানিকের ভাগনি। দীপাঞ্জনার কথায়, ‘মেসো যাতে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসতে পারেন, ঠাকুরের কাছে সেই প্রার্থনা করেছি।’ এই উদ্যোগে শামিল অঙ্কিত রায় বলে, ‘উনি আমার দাদু হন। টিভি, মোবাইলে দাদুর সুড়ঙ্গে আটকে থাকার খবর শুনে একদম ভালো লাগছে না।’ তাঁর আরাধ্য গোপাল ঠাকুর প্রিয় দাদুর মঙ্গল করবেন বলে অঙ্কিতের স্থির বিশ্বাস। একইভাবে গ্রামের অঙ্কিতা সাহা, অনুশ্রী সাহা, সন্দীপ শীলশর্মা, তানিশা তালুকদারের মতো খুদেরাও মনপ্রাণ দিয়ে মানিক সহ অন্যান্য শ্রমিকদের নিরাপদ উদ্ধারের খবর চাইছে।
এদিকে উত্তরকাশীতে অবস্থানরত ওই শ্রমিকের ভাইপো বিনয় তালুকদারের সঙ্গে এদিন ফোনে যোগাযোগ করা হয়। বিনয় বলেন, ‘সুড়ঙ্গের এত কাছে থেকেও প্রিয়জনের মুখ দেখতে পারছি না। যা বড় কষ্টের।’ বৃহস্পতিবার রাত থেকে উদ্ধারকারী সহ উত্তরাখন্ড প্রশাসন বারংবার আশ্বস্ত করলেও এখনও উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়ায় হতাশা বেড়েছে তাঁদের। এই সময়কালে নাওয়া, খাওয়া কার্যত উবে গিয়েছে। তবুও উদ্ধারের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে প্রিয় কাকাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে উন্মুখ হয়ে আছেন তিনি। অপরদিকে মানিকের ছেলে মণির কথায়, ‘ভেবেছিলাম এদিন দিনের বেলাতেই বাবার উদ্ধারের খবর পাব। কিন্তু তা হলনা। তাই ফের চিন্তা মাথায় নিয়েই আরেকটা বিনিদ্র রাত কাটাতে হবে।’