প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ অগ্নিগর্ভ মণিপুরের হাল ধরতে নয়াদিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখোমুখি হয়ে তাঁকে বিশেষ আর্জি জানাতে চেয়েছিল উপদ্রুত রাজ্যের তিন-তিনটি রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাঁদের। সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার পাঁচ দিবসীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজিপ্ট সফরে রওনা হলেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যস্ততার কারণে মণিপুরের কোনও প্রতিনিধি দলের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে পারেননি মোদি৷ এই তিনটি প্রতিনিধি দলের মধ্যে একটি রাজ্যের বিজেপি বিধায়কেরা, অন্যটি রাজ্যের বিধানসভা অধ্যক্ষের নেতৃত্বাধীন বিশেষ প্রতিনিধি দল এবং তৃতীয়টি হল গত ১০ জুন থেকে রাজধানী দিল্লিতে অপেক্ষারত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী ১০ টি প্রধান বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা। কিন্তু কেউই শেষমেশ দেখা পাননি প্রধানমন্ত্রীর৷ ফলস্বরূপ দিল্লি থেকে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে করম শ্যাম সিং, টি রবীন্দ্র, নিশিকান্ত সিং সাপাম, এস কেবি দেবীর মতো অসংখ্য বিধায়ক, নেতাদের। প্রায় দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে জাতিগত হিংসায় আক্রান্ত মণিপুরের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই অভাবনীয় উপেক্ষা এবং মৌনতা নিয়ে ক্ষোভের পারদ চড়ছে মণিপুরের রাজ্য রাজনৈতিক মহলে।
তবে বিশেষ সূত্রের দাবি, দিল্লি ছাড়ার আগে এদিন মণিপুরের বিরোধী দলগুলি একযোগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে একটি বিশেষ স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি দলের প্রতিনিধিরা রয়েছেন সেই তালিকায়। তার মধ্যে আম আদমি পার্টি, তৃণমূল, জাতীয় কংগ্রেস, সিপিএম, শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরের গোষ্ঠীও রয়েছে৷ বিরোধীদের দাবি, মণিপুরে একটি পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি তোলা হচ্ছে। তবে বিরোধী ওই রাজনৈতিক দলগুলির তরফে এই দাবির বিরোধিতা করা হয়েছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, বিজেপির বিভাজনমূলক রাজনীতির জেরেই মণিপুরের এও সমস্যা। কেন্দ্র এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে, অন্যদিকে রাজ্য বিজেপি সরকার পরিস্থিতির হাল ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সবচেয়ে মর্মান্তিক, এই ইস্যুতে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী মৌনতা ধারণ করায় গোটা পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
অন্যদিকে মণিপুরে গুলি চালনার ঘটনা যাতে বন্ধ হয় তার আবেদনও জানানো হয়েছে এদিন বিরোধীদের তরফে। ওই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মণিপুরে হিংসার ঘটনা অবিলম্বে কমাতে হবে। কুকি জঙ্গিদের কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে মণিপুরের দুর্গত মানুষদের জন্য কেন্দ্রের তরফে ১০১.৭৫ কোটি টাকার রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে বিরোধীরা জানিয়েছেন, এই অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া ইম্ফল থেকে ডিমাপুর পর্যন্ত জাতীয় সড়ক ২ খোলার ব্যাপারেও দাবি করা হয়েছে। বিরোধীদের দাবি, ৩ মে থেকে কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন হাইওয়ে আটকে রেখে দিয়েছে। এর জেরে গাড়ি যেতে পারছে না। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এর জেরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এনিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সদর্থক ও দ্রুত হস্তক্ষেপের দাবি তুলেছেন তারা। মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এদিন সাংবাদিক বৈঠক করেন রাজ্যের কংগ্রেস নেতা ওকরাম ইবোবি সিং। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর এনিয়ে বৈঠক করা দরকার। বিদেশ সফর থাকাকালীন তিনি সময় দিতে পারেননি, কিন্তু বিদেশ থেকে ফিরে মোদি এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন বলে তাঁরা আশাবাদী।
উল্লেখ্য মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মৌনতা ঝড় তুলেছে কেন্দ্রীর মহলে। মণিপুরে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হয়েছে গত ৩ মে। এরপর ৪৫ দিনের বেশি কেটে গেছে। এত দিন বিষয়টি নিয়ে কোনো কথাই বলেননি মোদি। ফলে অনেকের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ভারত ছাড়ার আগে গত রোববার ‘মন কি বাত’–এ মণিপুর প্রসঙ্গ পাড়বেন তিনি। তবে সেদিনও তিনি মৌন থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সমোস্বরে সমালোচনায় মেতেছেন বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতা। আশা ছিল, বিদেশে রওনার আগে পর্যন্ত অন্তত একবার মণিপুরের শাসক-বিরোধী উভয় ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি, দেবেন শান্তির বার্তা। কিন্তু সে পরিকল্পনা এখন বিশ বাঁও জলে৷ এদিন কংগ্রেসের তরফে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে, আরও একবার প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ‘রাজধর্ম’ মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়।