Friday, May 17, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ইভিএম বিতর্কের সমাধান কোথায়

ইভিএম বিতর্কের সমাধান কোথায়

  • যোগেন্দ্র যাদব

ইভিএম নিয়ে তর্কাতর্কি নতুন নয়। সময়ের সঙ্গে বিতর্কের পরিসরই শুধু বিস্তৃত হয়েছে। যেটা হয়নি, সেটা হল কীভাবে এই বিরোধের নিষ্পত্তি সম্ভব সেই পথের সন্ধান। তবে এই অন্তহীন বিতর্কের নিষ্পত্তির একটি উপায় রয়েছে। আমাদের অবশ্যই সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের এই একমাত্র উপাদানটিকে আমাদের বাঁচাতে হবে, যার কিছু বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে।

ইন্ডিয়া জোটের সাম্প্রতিক বৈঠকে নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়েছে। অদ্ভুতভাবে বিরোধী দলগুলির নেতারা একটিমাত্র ক্ষেত্রে একমত হয়ে প্রস্তাব পাশ করেছেন। তা হল, ইভিএমের সততা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ ও পেশাদারের মনেও এই নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে তাঁদের অনেকেই ইভিএম তুলে দিয়ে ব্যালট পেপার ফিরিয়ে আনার দাবির সঙ্গে একমত নন। গণনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে তাঁদের পরামর্শ হল, এখন যেমন ইভিএমের সঙ্গে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপ্যাট) মেশিন যুক্ত থাকে সেই ব্যবস্থা চালু রাখা। তবে বর্তমানে যেমন ভোট দেওয়ার পর ভিভিপ্যাটের স্লিপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি বক্সে জমা হয়, তা না করে সেটি ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। তারপর তাঁরা সেই স্লিপ একটি আলাদা ব্যালট বক্সে জমা করবেন। এরপর ভিভিপ্যাট স্লিপের ১০০ শতাংশ গণনা করতে হবে। তার ফল ইভিএমে প্রাপ্ত ফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার।

আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে একটা বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে, ইভিএম নিয়ে সন্দেহবাদী এবং এর সমর্থকদের মধ্যে যে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে তাতে আমি কিন্তু দ্বিতীয় শিবিরে রয়েছি। গত দেড় দশকে বড় নির্বাচনগুলির ফলাফলে হেরফের হয়েছে- এই অভিযোগ খণ্ডন করতে আমার কিছু পেশাগত শিক্ষা এবং বেশ কিছুটা সামাজিক অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তখন তাঁর বিরোধিতা করেছিলাম। যখন বিজেপি নেতারা (যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দলের অন্যতম মুখপাত্র জিভিএল নরসীমা রাও) ইভিএম নিয়ে সরব হয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। আবার কংগ্রেস শিবিরের লোকজন ২০১৪ ও ২০১৯-এর পরাজয়ের জন্য ইভিএমকে দায়ী করায় তার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলাম।

এই একগুঁয়েমির জন্যই বোধহয় রাজনৈতিক জীবনে অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। ইভিএম নিয়ে সন্দেহের কারণ মূলত ৩টি। এগুলির কোনওটাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এক, মেশিনের প্রতি অবিশ্বাস। যে কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্রকেই প্রোগ্রাম ও ম্যানিপুলেট করা যায়। মেশিন যত পরিশীলিত ততই তাতে কারচুপির সম্ভাবনা বেশি। দুই, বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অবিশ্বাসের কারণে এই সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছে। তিন, প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাস, যা এই সন্দেহকে পূর্ণ ষড়যন্ত্র তত্ত্বে পরিণত করেছে। দুঃখের ব্যাপার, স্বশাসিত নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বের দ্রুত অবক্ষয়ের কারণে এই আশা কেউ রাখেন না যে ক্ষমতাসীনদের কোনও অবৈধ দাবি কমিশন প্রতিহত করতে পারবে।

ওপরের ৩টি বৈধ অনুমানই প্রমাণ করে যে ইভিএমে কারচুপির একটি বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু গত নির্বাচনগুলির ফলাফলের ভিত্তিতে সেটা প্রমাণ করা যাবে না। নির্বাচনের ফল আমূল বদলে ফেলতে যে বিরাট সংখ্যায় ইভিএমে কারচুপি করা প্রয়োজন তেমন কিছু নজরে আসেনি। বছরের পর বছর ধরে ইভিএমে কারচুপির পক্ষে প্রাথমিক প্রমাণের খোঁজ করেছি। কিন্তু এমন কিছু পাইনি যা দেখে মনে হবে আমার সন্দেহ যুক্তিসংগত প্রমাণের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারে।

মধ্যপ্রদেশের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এমনকি সমীক্ষকদের বড় অংশ ৯ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে বিজেপির জয় প্রত্যাশা করেনি। আমিও ভোটের আগে রাজ্যটিকে চষে ফেলেছিলাম। তবে বিজেপির পক্ষে বিরাট হাওয়া অনুভব করিনি। অবশ্যই স্বীকার করছি যে, এই ফলকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। এখনও ভোট-পরিসংখ্যান নিয়ে আমার মধ্যে কিছু অস্বস্তি কাজ করছে। যদিও একে ইভিএমের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কংগ্রেসের তরফে দাবি করা হচ্ছে যে, ইভিএমের ভোটগণনা এবং পোস্টাল ব্যালটে গণনায় অসামঞ্জস্য রয়েছে। ওই ভারসাম্যহীনতা অদ্ভুত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। ছোট দল ও নির্দলদের প্রাপ্ত ভোটে ধস এবং বিজেপির ভোটপ্রাপ্তিতে সেই পরিমাণ বৃদ্ধি শাসকদলের চমকপ্রদ উত্থানের অন্যতম কারণ। বিজেপির ভোটবৃদ্ধি অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব নয়।

এই বিতর্কের সবচেযে বড় জট যাঁরা ইভিএমে কারচুপির অভিযোগের সঙ্গে একমত তাঁদের কাছে দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। সন্দেহবাদীরা ইভিএমে প্রযুক্তিগত এমন এক অলঙ্ঘনীয়তার নিশ্চয়তা চান যা নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও বোধহয় দেওয়া অসম্ভব। তবে এই বিতর্ক আরও জোরালো হোক সেটা কাম্য নয়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাগুলির দ্রুত অবক্ষয় ঘটছে। ক্ষমতাসীন দল ব্যাপক অন্যায্য সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। যার জেরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একমাত্র ন্যায্য উপাদান নির্বাচন ও ভোটগণনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

তাই এই লেখার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের বিবেচনার জন্য একটি প্রস্তাব রাখা হল। পুরোনো ব্যালট ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। এর ফলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু ভোটারদের হাতে ভিভিপ্যাট স্লিপ তুলে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতেই পারে। যদিও ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে হয়তো এই ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব নয়। পরিবর্তে নির্বাচনি ফলাফলের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশন নিম্নলিখিত চারটি পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পারে। এক, কমিশনের কন্ট্রোল ইউনিট, ভিভিপ্যাট এবং সিম্বল লোডিং ইউনিটের জন্য ব্যবহৃত সোর্সকোড পাবলিক ডোমেনে স্থাপন করা উচিত। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের এটির সত্যতা যাচাই করার অনুমতি দিতে হবে।

দুই, ইভিএমগুলি যে স্ট্যান্ড অ্যালোন ডিভাইস যা নির্বাচন ঘোষণার পর অন্য কোনও যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়নি তা সব জাতীয় এবং রাজ্য স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের দ্বারা নিযুক্ত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের যাচাই করার অনুমতি দেওয়া উচিত। তিন, প্রতীক লোডিং এবং ইভিএম চালু করার পর প্রার্থীদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সেগুলি সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটকেন্দ্রগুলিতে এলোমেলোভাবে (র‌্যান্ডম) বরাদ্দ করা হোক। চার, ভোটারদের যাচাই করা ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনা এবং ইভিএম থেকে প্রাপ্ত ভোটের ফল মিলে যাওয়ার পরেই নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম ৫৬ডি (৪) (ডি) অনুযায়ী কোনও গরমিল ধরা পড়লে যেন ফের ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনা করা হয়। এতে ফল ঘোষণা কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে যেতে পারে। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে নির্বাচন টি২০ ক্রিকেট ম্যাচ নয়।

(লেখক সেফোলজিস্ট ও রাজনীতিবিদ)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

0
Aishwarya Rai Bachchan কর্মই ধর্ম! ভাঙা হাতেই কানের রেড কার্পেটে ঐশ্বর্য, তবুও পাশে নেই অভিষেক বচ্চন৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিনে লাল গালিচায় সম্মোহনী জাদু...
weather update in west bengal

Weather Report | তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে অস্বস্তি, সোমেই হাওয়া বদল বঙ্গে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের তীব্র গরমে পুড়ছে রাজ্যবাসী। শনি ও রবিবার উত্তর ও দক্ষিণ দুই বঙ্গের ছয় জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি...

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

0
শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী ও শাশুড়ি। আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়ে...

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

0
শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান সহ তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠল...

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

0
মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের (Manikchak) গোপালপুরের ঘটনা। জানা গিয়েছে, দলীয় কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন...

Most Popular