- সন্দীপন নন্দী
খুব পুরোনো সেই দিনের কথা নয়। তবু চোখের দেখা, কানের শোনা, সে কি ভোলা যায়? প্রতিটি মফসসল শহরের জন্মবৃত্তান্তে একসময় অনিবার্য ছিল গানের স্কুল। অনুচ্চ, ধূসর, সুপারি গাছে ঘেরা টিনছাদের অলিগলির বাড়িগুলো। দূরান্ত হতে প্রথম তানকর্তব শিখতে আসা ছাত্রছাত্রীদের যে দালানবাড়ি তাই হন্য হয়ে খুঁজতে হয়নি কোনওদিন। বরং বিবরণের সঙ্গে হুবহু মিলে যেত সে গানবাড়ির অবয়ব। দলবাঁধা নবীন শিক্ষার্থীতে গমগম করত যে গানের স্কুল। যেখানে হলদে নীল শতরঞ্চির বাঁকে বাঁকে রয়ে যেত নব্য কণ্ঠসাধকদের স্মৃতিসুধা। যা এখন অনেকটাই সৌধ। কেউ আর গান শিখতে আসে না এ পাড়ায়। মাত্র ক’বছরেই নীরব হল মুখর গানের স্কুল।
অথচ সেকালে প্রতিটি শহরে ছন্দনীড়, সুরলহরী, তানঘর বা গীতমন্দির নামের আপাত শান্ত ও স্নিগ্ধ বাড়িগুলো থেকেই তানপুরা, হারমোনিয়ামের মৃদু সুর ‘সা’ হয়ে বাজত। মুগ্ধ হয়ে শুনত পথভোলা পথিক থেকে সাথীহারা পদাতিক। ঝড়ের রাতেও যে স্কুলে পরানসখার মতো চলত নিরবচ্ছিন্ন ইমন, মল্লারের আরোহ অবরোহের ক্লাস। আসলে তখনও এই সরগমময় জীবনগুলো রিয়েলিটি শোনির্ভর হয়নি। অনলাইনে ভজন – ভৈরবী শেখার চল আসেনি বঙ্গে। ক্ল্যাসিকাল মিউজিক আত্মস্থ করা ছিল স্রেফ একটা সাধনাসম। একজন শিক্ষিত শ্রোতা ও গায়কের মাঝে সুরসেতুর একমাত্র উৎস ছিল এই শাস্ত্রীয় সংগীত। ছ’মাস শিখেই রিল নির্মাণের তরে নয়, ইউটিউব দেখে পাঁচটা রাগ ঝালিয়ে, বহিরাগত শিল্পী নয়। ঘরে ঘরে শাস্ত্রীয়সংগীতের একটা ইজ্জত ছিল। লাইকনির্ভর গানবিশ্বের অহেতুক অহংকার নয়, তখন লোকে দু’কলি মারুবেহাগ গাওয়া শিল্পীকে সমীহ করতেন। গানের মাস্টারমশাইদের কাছে প্রগতির লক্ষ্যে ছুটে যেত ছেলেমেয়েরা। সময়স্রোতে সুর, তাল, ছন্দ ক্রমশ হয়ে উঠল এক গোধূলিবেলার মুক্তি।
সেকালে নবাগতরা নম্বরসর্বস্ব, র্যাংকমুখী হয়ে যায়নি। ফলে রাশিদ খানকে বলা লতা মঙ্গেশকরের সেই যুগবাণীই ছিল ঘরে ঘরে গানশিখিয়েদের আশ্রয়, মন্ত্র ‘পহলে শুনো, ফির শুনাও’। অথচ এখন আমরা শোনাতেই বেশি ব্যগ্র। খ্যাতি, যশ আর পুরস্কারের ভূত মেধার ধ্বংসস্তূপ গড়ে দিল নিমেষে। শাস্ত্রীয় সংগীত তার মর্যাদা হারাল। পুজোর গান হারিয়ে গেল চিরতরে। কণ্ঠে কণ্ঠে বেসুরো ক্ল্যাসিকাল ফিউশন দিনে দিনে হয়ে উঠল অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীসম। তারপর একসময় ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিল ট্র্যাকের গান। তবলা, মন্দিরার নির্বাসনে দলতান্ত্রিক সংগীতভুবনে প্রাধান্য পেল একনায়কতন্ত্র। মঞ্চে নিঃসঙ্গ হলেন সংগীতশিল্পীরা। বিজয়া সম্মিলনি, নবীনবরণ, শীতসন্ধ্যার পাড়ায় পাড়ায় বিরল হয়ে গেল ক্ল্যাসিকাল কনসার্ট। ধ্রুপদি সংগীতের নামে চলল ভুলভাল এক্সপেরিমেন্ট।
শ্রোতারা শ্রবণবিমুখ হলেন। প্রতিভাধর শিল্পীরা নিরুদ্দেশ হলেন। শ্রোতা টানতে বাধ্য হয়ে তালসর্বস্ব গানে মন দিলেন তাঁরা। দেখতে দেখতে শেষের সেদিন, একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে পাকাপাকিভাবে দরজা বন্ধ হল সমস্ত সরগম শেখা স্কুলবাড়িগুলোর। ধুলো জমল সাইনবোর্ডে। হারমোনিয়ামের জায়গা নিল সিন্থেসাইজার। আর বসে নয়, দাঁড়িয়ে প্রযোজিত হল অন্যধারার গানমালা। রাগপ্রধান গান শুধু জেলা কিংবা রাজ্য স্তরের সংগীত প্রতিযোগিতাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে সুর যে মাটি খুঁড়ে জল পাবার শামিল কিংবা বন্দিশ যে সুরের ভাস্কর্য গড়ার মতো এক অভূতপূর্ব ঘটনা, আজ অজ্ঞাত একালের অমলধবল কচিমুখগুলোর কাছে।
(লেখক বালুরঘাটের বাসিন্দা, প্রবন্ধকার)