- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডনে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট নেতা মার্ক ফিশারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ফিশার তখন সিপিজিবি (কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট ব্রিটেন)-র সাধারণ সম্পাদক। এই আলোচনার বিষয়গুলির ভিতর একটি ছিল, জনগণের ভিতর প্রচার চালানোর সময় কোন কোন দিকগুলির ওপর ওই দেশের রাজনৈতিক দলগুলি গুরুত্ব দেয়। ফিশার যে দিকগুলির কথা বলেছিলেন তার ভিতর পরিবেশ অন্যতম। ফিশার বলেছিলেন, পরিবেশ রক্ষা করার বিষয়টিতে আমাদের গুরুত্ব দিতে হয়। এখানে সরকার এবং জনগণ পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত সচেতন।
চারদিন পরে দার্জিলিং কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। এমনিতে পাহাড়ে ভোট নিয়ে তেমন তাপ-উত্তাপ দেখা যায় না। সমতলে যেমন ভোট মানেই উত্তেজনা, হিংসা এবং পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি- পাহাড়ে তেমনটি নয়। পাহাড়ে ভোট হয় শান্তিতে। কোনওরকম হিংসা এবং উত্তেজনা ছাড়াই পাহাড়ের মানুষ নিজেদের ভোটটি দিয়ে আসেন। পাহাড়েও ভোটের প্রচার আছে, পোস্টার লাগানো আছে, মিছিল-মিটিংও আছে। তবে তা এতটাই শান্তিতে যে উত্তাপটি অনুভব করা যায় না। ভোট নিয়ে পাহাড়ের মানুষ নিজেদের ভিতর আলোচনাও করেন।
মাঝে মাঝেই কার্সিয়াংয়ে গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকার সুবাদে ওই অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে আমার। এই কিছুদিন আগে, ভোটের মরশুমেই দুটি সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম দার্জিলিং পাহাড়ে। সেখানে ভূমিপুত্র এমন অনেকের সঙ্গেই ভোট নিয়ে আলোচনা হল।
লেখার শুরুতেই ফিশার যে রাজনৈতিক দলের প্রচারে পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তার উল্লেখ করেছি। কেন করেছি এবার তা বলি। ভোট নিয়ে যখন আলোচনা করেছি পাহাড়ের বাসিন্দা আমার পরিচিত মানুষের সঙ্গে, তখন নানা বিষয়ে তাঁরা তাঁদের ক্ষোভ এবং উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। অপ্রাপ্তির কথা জানিয়েছেন। তাঁদের উদ্বেগের বিষয়গুলির ভিতর যেটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা বলেছেন, সেটি পরিবেশ। এবং তাঁদের এটাও ক্ষোভ, পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিতে কোনও রাজনৈতিক দলই সচেতন নয়। কারও প্রচারেই বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায় না। সংবাদমাধ্যম এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের একাংশও এই বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন। আর এই উদাসীনতা পাহাড়কে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এঁদের অভিযোগগুলি যে খুব ভুল বা এঁরা যে অতিরঞ্জিত করে কিছু বলছেন, এমন কিন্তু নয়। একটি অশনিসংকেতের দিকে এঁরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক পক্ষ থেকে আমরা পাঁচ পাবলিক সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকছি। দার্জিলিং পাহাড় কয়েক যুগ ধরে বাঙালির পছন্দের বেড়ানোর জায়গা। সাহেবদের পত্তন করা দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়াং এককালে বাঙালিবাবুদের গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটানোর জায়গা ছিল। সাহেবদের অনুকরণে বহু বাঙালিবাবু পাহাড়ে নিজেদের গ্রীষ্মকালীন আবাসও বানিয়েছিলেন। গত কয়েক বছরে দার্জিলিংয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। পর্যটন ব্যবসার প্রসারও ঘটেছে অনেক। কিন্তু কেভেন্টার্সে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাওয়া, গ্লেনারিজের সামনে ছবি তোলা বাঙালি দার্জিলিং পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষা করা নিয়ে কতটা ভেবেছি? পাহাড়ের ভূমিপুত্ররা অনেকেই বলছেন, কেউ ভাবেনি। কেউ ভাবছেও না। ভাবছে না বলেই ভূমিকম্পপ্রবণ হিমালয় পর্বতাঞ্চলের এই অংশটিতে অবাধে পাহাড় কেটে বড় বড় নির্মাণকার্য চলছে। যার ফলে এই পাহাড় আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। ক্রমশই আরও বেশি বিপদের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে দার্জিলিং পাহাড়।
ভুল বলছেন না এঁরা। পরিযায়ী পর্যটকের চোখে না দেখে কেউ যদি পরিবেশ ভাবনাটি মাথায় রেখে একবার দার্জিলিং পাহাড়ের দিকে তাকান, তাঁর চোখেই ধরা পড়বে গত কয়েক বছরে কীরকম অবাধে পাহাড় কেটে ইট বালি সিমেন্টের বড় বড় নির্মাণ হয়েছে। এবং এখনও হচ্ছে। ভূমিপুত্ররা বলছিলেন, ‘আমরা আমাদের বাপ-দাদার কাছে শুনেছি এই পাহাড়ে কাঠের বাড়ি বানাতে হয়। কাঠের বাড়ি পরিবেশকে নিরাপদ রাখে, মানুষজনকেও নিরাপদ রাখে। কিন্তু এখন এসব শুনছে কে? বাইরে থেকে লোকজন এসে বড় বড় প্রাসাদোপম হোটেল বানাচ্ছে। তাই দেখে পাহাড়ের অনেক বাসিন্দাও ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে বড় বড় বাড়িঘর বানিয়ে ফেলছে। পাহাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আমাদের আশঙ্কা এই ভার পাহাড় ধারণ করতে পারবে না দীর্ঘদিন। ভয় হয়, কোনওদিন না উত্তরকাশীর মতো বিপর্যয় ঘটে যায় আমাদের পাহাড়ে।’
জানতে চেয়েছিলাম, স্থানীয় প্রশাসন কী করে? এই ধরনের নির্মাণে তারা ছাড়পত্র দেয় কীভাবে। স্থানীয়রা বললেন, সমস্তকিছুই হয় নেতাদের প্রশ্রয়ে। কাজেই প্রশাসন চুপ করে থাকে। দার্জিলিং পাহাড়ের পরিবেশ যে ধ্বংস হতে বসেছে, এ নিয়ে কেউ কোনও কথাই বলে না। গত দশ বছর এই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও এ নিয়ে নীরব। শুধু দার্জিলিং পাহাড় নয়। পাহাড়ের পাদদেশে সুকনা বনাঞ্চলও ধ্বংস করা হচ্ছে। এই অভিযোগও ওই ভূমিপুত্রদের। তাঁরা বলছেন, সুকনা ফরেস্টের একটু গভীরে ঢুকে দেখবেন কী নির্বিচারে গাছ কেটে কাঠ পাচার করা হয়েছে। এই নির্বিচারে গাছ কাটার ফল ক্রমশ ভুগতে হবে শিলিগুড়ি এবং সন্নিহিত অঞ্চলকে। এই গাছ কেটে কাঠ পাচার করায় সব বলশালী রাজনৈতিক নেতারাই নাকি ভাই-ভাই।
এতকিছু ভূমিপুত্র বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুনছে কে? পাহাড় ফাটিয়ে টানেল করে উন্নয়ন প্রদর্শনের বিরোধিতা করেছিলেন পরিবেশবিদরা। সরকার তাদের কথা শোনেনি। কারণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার থেকেও কসমেটিক উন্নয়নে ‘অচ্ছে দিনের’ স্লোগানটিকে মজবুত করাই ছিল সরকারের লক্ষ্য। উত্তরকাশীর ভয়াবহ বিপর্যয় মানুষের জীবন এবং জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। আমরা ক’জন মনে রেখেছি তরুণ সন্ন্যাসী নিগমানন্দ সরস্বতী বা প্রবীণ সমাজকর্মী জিডি আগরওয়ালের কথা? যাঁরা গঙ্গার তীরে অবৈধ নির্মাণের ফলে পরিবেশ ধ্বংসের বিরোধিতা করে অনশনে নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন? আমরা ক’জন সচেতন আছি লাদাখে সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ লাদাখবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে? সরকার ঘনিষ্ঠ জমি হাঙর শিল্পগোষ্ঠীর হাত থেকে লাদাখের পরিবেশ এবং সংস্কৃতি রক্ষা করার দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, আমরা ক’জন তার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছি?
কিছুদিন আগে কলকাতায় শ্রমিক স্বার্থ, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করা অসরকারি সংগঠন নাগরিক মঞ্চের উদ্যোগে পরিবেশ সংক্রান্ত একটি আলোচনা সভা হয়ে গেল। সেই সভায় উপস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পরিবেশ নিয়ে তাঁদের উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করলেন। তাঁদের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, তাঁরা যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেইসব দলের নির্বাচনি ইস্তাহারে পরিবেশ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না কেন?
সরকারের কাছে এসব ভাবনা মূল্যহীন। প্রাজ্ঞের দূরদর্শিতা নয়। সরকারের পছন্দ ঝাড়বাতির আলোয় উদ্ভাসিত মূর্খের বিলাসিতায়। কিন্তু আমরা, পাঁচ পাবলিক? আমরা কবে বুঝব পাহাড় ধ্বংস হলে সমতলও নিরাপদে থাকে না।