- সন্দীপ সি জৈন
কোনও না কোনও কারণে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি পাহাড়েই রয়েছি। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে পাহাড় ছেড়ে বেরোইনি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দার্জিলিংয়ে যা ঘটছে তার বাইরে দেশের অন্য রাজ্যের লোকসভা কেন্দ্রগুলির নির্বাচনি হালহকিকত সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তবে ভোট ঘোষণার পর থেকে আমাকে বিস্মিত করেছে একটা জিনিস। দেশের অন্য রাজ্যগুলির মতো পাহাড়ে ভোট ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনও উৎসাহই দেখতে পাচ্ছি না।
যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদযাপনে নির্বাচনকে সবচেয়ে বড় উৎসব বলা হয়। কিন্তু এবার এখানে যা দেখা যাচ্ছে, সেই উৎসব ভুলে যাওয়া বা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার প্রবণতা খুব চিন্তার। নানা দলের কর্মী-সমর্থকরা যে উৎসাহের সঙ্গে প্রচার চালিয়েছিলেন, তাঁদের নেতারা যে উৎসাহে রাস্তার পাশে পথসভা বা জনসমাবেশ করেছিলেন এবং সেখানে যে উচ্চমানের ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হয়েছিল তা এককথায় অভূতপূর্ব। নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে বাড়ি বাড়ি প্রচার (পড়ুন শুধু প্রতিশ্রুতি বিতরণ) করেছিলেন, এখন পর্যন্ত তার সবই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলেই মনে হচ্ছে।
অথচ প্রকৃত বাস্তব হল, ভোটের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। তাহলে এটাই কি পাহাড়ের জন্য অপেক্ষারত অনিবার্য ভাগ্যের গ্রহণযোগ্যতা? নাকি প্রতিটি নির্বচনের আগে ভোটারদের বিরক্তি উৎপাদনকারী টুঁটি টিপে ধরা অসত্য প্রতারণা? এজন্যই কি পাহাড়ের মানুষ নির্বাচন নামক নাটকে অনাগ্রহী? নাকি এমন কিছু যা আমি সত্যিই এখনও চিহ্নিত করতে বা বুঝতে পারিনি। বাস্তব হল, আমরা সাধারণত যেভাবে ভোট দেখতে অভ্যস্ত আসন্ন লোকসভা নির্বাচন আসলে গণতন্ত্রের উৎসবের মতো মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে দার্জিলিং লোকসভা আসনে।
১৯৮৫-র ৯ নভেম্বর প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার সম্মানে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত নৈশভোজ হয়েছিল। সেখানে হলিউড সুপারস্টার জন ট্রাভোল্টার আমন্ত্রণে লেডি ডায়না তাঁর সঙ্গে নেচেছিলেন। তাল, লয়হীন সে নাচ ট্রাভোল্টা ডান্স হিসাবে পরিচিত। প্রচারে কিছু কিছু নেতা সেই ট্রাভোল্টার মতো নেচেকুঁদে রীতিমতো হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছেন। নির্বাচিত হওয়া দলের সঙ্গে বিচ্ছেদ রাজনৈতিক দলগুলির এখন আর একটি ভিন্ন রূপ হয়ে দেখা যাচ্ছে। এমনকি, অনাবশ্যকভাবে পাহাড়ের প্রাক্তন অঘোষিত রাজার আনুগত্যের প্রতি অস্থিরতা, দার্জিলিং আসনে প্রার্থী ঘোষণায় বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির সিদ্ধান্তহীনতা, অগ্নিকন্যা বন্দনা রাইয়ের মতো নির্দল প্রার্থীর উত্থান, কংগ্রেস ও সিপিএমের জোট একটি গরমাগরম ছায়াছবির চিত্রনাট্য তৈরির পটভূমিকা রচনা করেছে। তবে, এখন দেখার বিষয়, প্রচারের সময় সাধারণ মানুষের এই অনাগ্রহ কি পরিবর্তন নাকি অসহায়তার লক্ষণ।
পাহাড়ের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, দার্জিলিং লোকসভা আসনের বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্টের পক্ষে ২০১৯ সালের মতো এবার আসনটি নিজের দখলে রাখা ততটা সহজ হবে না। সেবার তিনি চার লাখ ১৩ হাজারের বেশি ভোটের বিশাল ব্যবধানে জিতেছিলেন। যা ছিল মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় প্রায় ৬০ শতাংশ। ওই নির্বাচনে নিঃসন্দেহে এই ফল যে কোনও মানদণ্ডে খুবই দর্শনীয়, প্রশংসাযোগ্যও বটে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ২০১৯ সালের রাজনীতি ও পরিস্থিতি এখনকার থেকে একদম ভিন্ন ছিল। তখন গোটা দেশ মোদি তরঙ্গে ভাসছিল। সেসময় পাহাড়ে ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা (বিজিপিএম)-র রমরমা। তারাই এখন গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) চালাচ্ছে। কিন্তু তখন তাদের সমাজের একদম তৃণমূল স্তর অবধি প্রতিষ্ঠা মেলেনি। এই আসনে সিপিএম এবং কংগ্রেস পৃথক পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। এই সময় তাদের কাছে এমন এমন প্রার্থী রয়েছেন যাঁরা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ক্যারিশম্যাটিক। আছেন বন্দনা রাই, বিপি বজগায়েনের মতো অন্য দলের প্রার্থী।
২০১৯ সালের ভোটে এই ফ্যাক্টরগুলির অস্তিত্ব ছিল না। গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে বিজেপির ইস্তাহার বধির ও নীরব। এবার তৃণমূল-বিজিপিএম জোট প্রার্থী দার্জিলিং সংসদীয় আসনের তরাই অঞ্চলে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও অত্যন্ত নিবিড়। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি (ক্ষমতা বিরোধী) ফ্যাক্টরের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতিও এই সময় একটি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে।
ফলত, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনি ফলাফলের কোনও আগাম মূল্যায়ন করা বোকামি হবে। অবশ্যই ২০১৯ সালের ফলাফলকে গাইডলাইন ধরে নিয়ে একটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতেই পারি। রাজু বিস্ট সেবার তৃণমূল, বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের ছাপিয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভোট পেয়েছিলেন। অমর রাই সে তুলনায় অর্ধেকেরও কম ভোট পান। দার্জিলিং লোকসভা আসনটিতে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে চারটি শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া, ফাঁসিদেওয়া ও চোপড়া সমতলে। আর তিনটি অর্থাৎ দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্সিয়াং পাহাড়ে। আনুমানিক মোট ভোটারের ৬০ শতাংশ সমতলে, বাকি ৪০ শতাংশ পাহাড়ে।
২০১৯ সালের আগের নির্বাচনগুলিতে লক্ষ করা গিয়েছে যে, পাহাড়ের ভোটাররা সাধারণত একজন নির্দিষ্ট প্রার্থীকেই একযোগে ভোট দেন। কিন্তু সমতলের ভোটারদের ভোট সাধারণত বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে পাহাড়বাসীরা যে প্রার্থীকে সমর্থন করতেন তাঁর জয় ছিল অনিবার্য। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। আমি এজন্য পাহাড়ে একজন ক্যারিশম্যাটিক এবং জনপ্রিয় নেতার অনুপস্থিতিকে প্রধান কারণ বলব। এজন্যই দার্জিলিং সংসদীয় আসনের পার্বত্য ও সমতল দুই অংশেই বিজেপির উত্থান হয়েছিল।
লক্ষ করার মতো একটি মজার বিষয় হল, রাজু বিস্ট পাহাড় ও সমতলে অমর রাইয়ের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮০-সালের শেষের দিকে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে জিএনএলএফ-এর উত্থানের পর সেবারই প্রথম পাহাড়ের ভোট খণ্ডিত হয়েছিল। যার ফলাফল সবাই দেখেছেন। চলতি সময়ে সেই ছবিটা সম্পূর্ণ উলটে গিয়েছে। এখন পাহাড়ের ভোট একাধিক প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আর সমতলের ভোটররা নির্দিষ্ট একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে শুরু করেছেন৷
২০১৯ সালের নির্বাচনে বিস্ট দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছয়টিতে বেশি ভোট পেয়ে লিড নিয়েছিলেন। শুধুমাত্র চোপড়া বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী লিড পেয়েছিলেন। যদি পাহাড় ও সমতলের তুলনা করতে হয় তাহলে দুজনেরই প্রাপ্ত ভোটের ছবিটা এক ঝলক দেখতে হবে। সমতলে বিস্ট প্রায় চার লাখ পাঁচ হাজার ভোট পান। আর অমর রাই পান প্রায় দু’লাখ সাড়ে ৩৬ হাজার ভোট। পাহাড়ে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপিরই সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া তিন লাখ ৪৪ হাজার ১০০টি ভোট পেয়েছিলেন। এসব তথ্য ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচারবিশ্লষণ করে আমার পর্যবেক্ষণ, এই আসনে আসন্ন নির্বাচনে বিস্ট পাহাড়ে প্রায় ২০ শতাংশ ভোট হারাবেন। এবং এতদিনের অভিজ্ঞতা বলছে, সমতলেও তিনি আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ ভোট হারাতে পারেন। সব মিলিয়ে বাস্তবে ভোটে কী হবে, সেটা পরের ব্যাপার।
এবার পাঠকরাই তাঁদের নিজস্ব অঙ্ক কষা শুরু করতে পারেন।
(লেখক কালিম্পং হিমালয়ান টাইমসের সম্পাদক। কালিম্পংয়ের বাসিন্দা)