মৌমিতা আলম: আব্বা চিৎকার করেন আতর কোথায়? আম্মা বেরিয়ে আসেন রান্নাঘর থেকে। আম্মা, আব্বার কানের লতি ও দুই হাতে আতর লাগিয়ে দেন/আব্বা আতর লাগিয়ে ইদগাহে যান। আব্বার শরীরজুড়ে কনৌজ আতরের সুবাস/ মায়ের গায়ে ঘাম, ঘি, জাফরান আর গরম মশলার গন্ধ/আব্বা সবার জন্য দোয়া করেন ইদগাহ ময়দানে/মা মাংস মেরিনেট করে রাখেন দই দিয়ে ওরা বলে ইদগাহ পবিত্র জায়গা।/কিন্ত রান্নাঘর? মা উত্তর দেয় না। আত্তারের মূল কবিতা ভাবানুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়।
আম্মার এই নিস্তব্ধতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মায়ে শ্রমের গন্ধ। যে শ্রমের জন্য আম্মাকে কেউ পারিশ্রমিক দেয় না। রান্নাঘরে আম্মার একার শ্রমের স্বীকৃতি জোটে না। উৎসব থেকে অনুষ্ঠান, সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানের এই বিশাল শ্রমের বাজারে নারী শ্রম বিনা পারিশ্রমিকের নিস্তব্ধ খাটুনি। সমস্ত উৎসব, ধর্মীয় আচার আচরণ টিকেই আছে নারীদের এই শ্রমের উপরে।
ইদের দিন প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও আমার নানি যত্ন করে ভোর বেলা উঠে লাগাতেন পায়জামার ফিতে, পাঞ্জাবির বোতাম। আমার আম্মা শিখেছেন আমার নানির কাছ থেকে। এখন আম্মা বোতাম লাগান আমার আব্বার জন্য। পুরুষতন্ত্র এভাবে জিইয়ে রেখেছে বিনা পারিশ্রমিকের এই শ্রম।
উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে ফিরছেন একজন মহিলা তার ছেলের কাছ থেকে। মহালয়ার ঠিক পরের দিন। তার ছেলেও ফিরবে পুজোর সময়। একা ফিরছেন কেন জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, জানো তো মেয়েদের কত কাজ, ঘর পরিষ্কার করা, ঘর মোছা, পর্দা কাচা! মেয়েদেড় কাজ মেয়েরা না করলে কে করবে! আমার ছেলের বাবা জানলা খুলে জানলাটাও লাগাতে পারেন না। এই ষাটোর্ধ্ব মহিলা কিন্তু ছেলের বাবাকে বাড়িতেই রেখে গিয়েছেন। কিন্তু মেয়েদের কাজ তো! তাই…।
যদিও মেয়েদের কাজ যেটা বলা হচ্ছে সেটা আসলে শ্রম, বিনা পারিশ্রমিকের শ্রম।
বাড়িতে কাজ চলছে, মিস্ত্রি দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা পুজোর প্রস্তুতি শেষ? তিনি বললেন আর কি, বাজার (নতুন জামা ইত্যাদি) বৌ করেছে আর বাড়িঘর পরিষ্কার তো মেয়েদের কাজ সেটা বৌ আর মা মিলে করেছে। এ ছবি উত্তরবঙ্গে আছে। দক্ষিণবঙ্গেও আছে। গোটা ভারতেই রয়েছে।
ভালো বৌ ও ভালো মেয়ে হতে গেলে এই শ্রম দিয়ে যেতে হবে-এই শিক্ষা এতটাই মনের গভীরে যে, সারাদিন সীমাহীন খাটনি খাটার পরেও বাড়ির নারীদের আক্ষেপ, দশটা হাত নিয়ে দেবী দুর্গা হতে পারলে ভালো হত!
এই গডেস সিন্ড্রোম নিয়ে তাই মার্থা বেক বলেছেন, আমাদের সংস্কৃতিতে ভালো মেয়ে বলতে দুটো জিনিস শিখিয়েছে। এক ব্যক্তিগতভাবে সফল ব্যক্তি আর দুই নিজেদের সমস্ত স্বার্থত্যাগ করা গার্হস্থ্য দেবী।
এই ভালো মেয়ে ধারণা এতটাই মন ও মননে নিমজ্জিত যে, দ্য ইকনমিক টাইমস-এর রিপোর্টে প্রকাশিত ২০২০ সালে গুয়াহাটি হাইকোর্ট, একটি রায়ে স্বামীকে বিচ্ছেদ দেওয়ার অনুমতি দেন এই বলে যে, সেই নারীর সংসার করার ইচ্ছে নেই কারণ সে শাঁখা, সিঁদুর পরে না! তার কয়দিন পরেই, ইন্ডিয়া টুডের(২৫ জুন, ২০২০) রিপোর্ট অনুয়াযী কর্ণাটক হাইকোর্ট ধর্ষককে জামিন দেয় এই মর্মে যে, ধর্ষণের পর ধর্ষিতা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন যা কি না ভারতীয় নারীসুলভ নয়।
মাটির মতন ক্ষমাশীল, রূপে লক্ষ্মী ও গুণে সরস্বতী হতে হবে, এই ভাবনা শিখে নারী মুখ বুজে সহ্য করে সব বেগার খাটুনি। করবা চৌথ থেকে নানারকম উপোস সবেতেই নারীদের বেগার শ্রমকে মহিমান্বিত করা হয়।
ভালো মেয়েদের ধারণা (যা ভীষণভাবে পুরুষতান্ত্রিক) ও তাড়নায় এই দেবী বা ভালো মেয়ে হওয়ার বা সাজার প্রতিনিয়ত নারী প্রয়াসের পেছনের শ্রমকে তাড়িয়ে উপভোগ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ইদের বিরিয়ানি বা লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু, পুজোর ভোগ থেকে শুরু করে শবেবরাতের একশো-দুশো রুটি ও হালুয়া সবেতেই বেগার খাটুনি। উৎসব প্রিয় বাঙালির রসনা তৃপ্তির সবটা মেটায় নারীদের এই বেগার শ্রম।
শুধুই রসনা তৃপ্তিই নয়। উৎসব মানেই নারীদের সবথেকে ভালো দেখার (পুরুষদের চোখে) হিস্টিরিয়া। এই হিস্টিরিয়া এতটাই যে, পার্লার থেকে সেলুন, শাড়ির দোকান থেকে টেলারিং-এর দোকান সবেতেই লম্বা লাইন। ইদের দিন বীরপুংগবদের ইদগাহ পাঠিয়ে মেয়ে সাজতে বসেন। আমার শাশুড়ি মা-এর নির্দেশ, সেজে বসে থাকতে হবে তার ইদগাহ ফেরত ছেলের জন্য। আর আমার মাথায় তখন শুধুই চিন্তা দুপুরের খাবারের আয়োজনের।
আকছার শোনা য়ায় শপিংয়ে লিফটে দুই নারীর গল্প-আমার স্বামী তো কিছুই পারেন না, সব আমায় কিনে দিতে হয়।
নারী য়খন অন্যের(পড়ুন পুরুষতন্ত্রের) এই গ্লোরিতে ব্যস্ত, বাড়ির পুরুষটি তখন হয় ক্রিকেট খেলা দেখছেন বা শেয়ার মার্কেট-এর হালহকিকত নিয়ে তর্জায় ব্যস্ত, কিংবা ২০২৪-এ কে জিতবে সেটা নিয়ে ওপেড পড়ছেন। নারী যখন উৎসবের জন্য পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের জন্য নিজের শ্রম ব্যয় করছেন, পুরুষ তখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক পুঁজি লাভ করছেন।
পরিসংখ্যান বলেছে ভারতীয় মহিলারা যখন পারিবারিক কাজে ৭২ ঘণ্টা বিনা পারিশ্রমিকের শ্রম দান করেন, পুরুষরা দেন ২.৮ ঘণ্টা। এই সময়-দারিদ্র্য ভারতীয় মহিলাদের আর্থিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার এক বিরাট কারণ। নারীদের এই হাড়ভাঙা খাটুনি শুধুই য়ে অর্থনৈতিকভাবে মেয়েদের পিছিয়ে দিচ্ছে তাই নয়।
শারীরিকভাবেও এর মূল্য চোকাতে হচ্ছে নারীদের। টাইম (TIME)-এ প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুয়াযী, বিশ্বের অটো ইমিউন রোগে ভোগা মানুষদের মধ্যে ৮০% হল নারী। ইনসমনিয়া, কোভিড, ইরিটেবল বয়ে সিন্ড্রোম-এর মতো অসুখগুলো হওয়ার প্রবণতা নারীদের বেশি। PTSD, অবসাদ হওয়ার সম্ভাবনা নারীদের দ্বিগুণ পুরুষদের থেকে। আর মারাত্মক মানসিক রোগ অ্যানোরেক্সিয়া(anorexia) হওয়ার সম্ভাবনা নয়গুণ বেশি পুরুষদের থেকে।
উৎসব থাকুক, উৎসাহবিহীন জীবন একঘেয়ে কিন্তু সেই উৎসব হোক সম শ্রম দিয়ে তাই এবার দশমীর প্রণাম নিতে গিয়ে আশীর্বাদ করুন, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে নয়, হও কালীর মতো বা য়া ইচ্ছে হও। এবার ঈদি দিতে গিয়ে মেয়েদের সেখান, আব্বা পায়জামার ফিতে নিজেও বাঁধতে পারেন। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে- এই সবকিছু পারার ও পারফেক্ট হওয়ার পুরুষতান্ত্রিক ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে আসুন। পুরুষ যদি শুধু পুরুষ হয়ে ভগবান সেজে পা দোলাতে পারে, তবে নারীরা কেন নয়?
একটু অপ্রিয় হতে শিখুন। বর্তমান সমাজ কাঠামোয় প্রিয় হওয়া মানে স্ট্যাটাস কো মেনে নেওয়া। আর এই স্ট্যাটাস কো হল নারীর বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমের শোষক। একটু খারাপ হলে দোষ কী? যেখানে খারাপ ও ভালো দুটোই বড্ড পুরুষতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া নড়বড়ে ও একপেশে শব্দ।
(লেখক ময়নাগুড়ির বাকালির বাসিন্দা, শিক্ষক)