Tuesday, May 14, 2024
HomeMust-Read Newsবিদ্যাসাগরের সাহচর্য পাওয়া এই জমিদার বাড়ির মহিলাদের দুর্গাপুজোয় পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়

বিদ্যাসাগরের সাহচর্য পাওয়া এই জমিদার বাড়ির মহিলাদের দুর্গাপুজোয় পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়

প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহচর্য পাওয়া পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চকদিঘির সিংহরায় জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় পর্দার আড়ালেই থাকতে হয় মহিলাদের। জমিদারি প্রথা এখন আর নেই। তবুও সিংহরায় পরিবারের মহিলাদের আজও এমন ভবিতব্য মেনে নিয়েই চলতে হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন হয়। সেই সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চকদিঘির জমিদারদের নামও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলীন হয়ে গেলেও প্রায় ৩৭৫ বছর ধরে চকদিঘির বাগানবাটি সেই জমিদারি ঐতিহ্যেরই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একশো বিঘা জমিজুড়ে রয়েছে জমিদারদের বাগানবাটি। যার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে জমিদারি রাজত্বের নানা নিদর্শন। ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে এই বাগানবাটির সুবিশাল মন্দিরে প্রায় ২৮৭ বছর ধরে পুজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। একসময়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় দুর্গাপজোয় এসে থাকতেন এই বাগানবাটিতে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও তাঁর সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এই বাগানবাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। জমিদারি রাজত্ব আর নেই। তবে জমিদারি আভিজাত্যের গড়িমা অটুট রেখেছেন চকদিঘির জমিদার সারদপ্রসাদ সিংহরায়ের উত্তরসূরিরা।

চকদিঘির জমিদারদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজপুত ক্ষত্রিয়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুন্দেলখণ্ডের শাসকদের বংশধররা এখানে জমিদারি চালাতেন। দুর্গাচরণ রায় লিখিত ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে চকদিঘির জমিদারদের কথা। তা থেকে জানা যায় রাজস্থান থেকে চকদিঘিতে সর্বপ্রথম এসে ছাউনি ফেলেছিলেন নল সিং। সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে জমিদারি স্বত্ব লাভের পর নল সিং অগাধ ঐশ্বর্য্য ও খ্যাতি লাভে সমর্থ হন। কথিত আছে এই জমিদারি তিনি লাভ করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে। দামোদরের পূর্ব তীরের শুড়া মৌজাস্থিত হাজামজা জলাশয় ও দিঘি বিশিষ্ট নিস্কর জমিদারি স্থানটি পরবর্তীকলে পরিচিতি পায় চকদিঘি নামে।

এই জমিদার বংশের খ্যাতি শীর্ষে পৌঁছেছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের হাত ধরে। প্রজাবৎসল জমিদার সারদাপ্রসাদ তার জমিদারি এলাকার প্রভুত উন্নতি সাধনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি চকদিঘিতে তৈরি করেছিলেন বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এছাড়াও চকদিঘি হাসপাতাল এবং আজকের মেমারি-চকদিঘি সড়কপথ সবই তৈরি হয়ছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের একান্ত উদ্যোগে। জমিদার হয়েও ভোগবিলাসকে তুচ্ছ করে তিনি জনসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়জিত করেছিলেন। প্রজারা একান্তভাবে ছিলেন সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের গুনমুগ্ধ। জমিদার বংশের পরবর্তী প্রজন্ম লোলিতমোহন সিংহ রায়, লীলামোহন সিংহ রায় প্রমুখরা সারদাপ্রসাদ সিংহ রায়ের পথ অনুসরণ করে জমিদারি চালিয়েছিলেন। বর্তমান বংশধর অম্বরিশ সিংহ রায় একইভাবে পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছেন।

জমিদারদের বাগানবড়ির জন্য চকদিঘির নামডাক। বাগানবাটি জুড়ে আছে বড় বড় অট্টালিকা, কাছারি বাড়ি, অন্দর বাড়ি, একাধিক দিঘি ও গোমস্তাখানা। জমিদার পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই বাগান বাটিতেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থাকার জন্য একটি জলাশয়ের ধারে তৈরি হয়েছিল হাওয়াখানা ঘর। যে ঘরটির পরিচিত হাওয়া মহল নামেই। জমিদারি আমলে বাগানবাটিতে তৈরি হওয়া হাতি শাল ও ঘোড়া শালের অস্তিত্ব এখন বিলিন হতে বসেছে।

বাগান বাটির ভিতর কাছাড়ি বাড়ির সামনেই রয়েছে দুর্গা পুজোর স্থায়ী মন্দির। মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া বিশাল আকার বসার জায়গা। জমিদার বাড়ির কেয়ারটেকার সুশান্ত দত্ত জানিয়েছেন, এই জমিদার পরিবারের অপর দুর্গা মন্দিরটি রয়ছে চকদিঘি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে মণিরামবাটি গ্রামে। সেখানকার মন্দিরটিও একই আদলে তৈরি। সেখানেও জমিদারি ঐতিহ্য মেনে পুজোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়। পঞ্জিকার সময় সারনি মেনে একই সময়ে দুই ঠাকুর মন্দিরে হয় পুজো। ব্যবসা ও কর্মসূত্রে সিংহরায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বছরের বাকি দিনগুলিতে কলকাতা ও অন্যত্র কাটান। তবে পুজোর কটাদিন গোটা পরিবার একত্রিত হন চকদিঘির বাগানবাটিতে।

বৈদিক মতে হয় সিংহরায় জমিদার বড়ির দুর্গাপুজোর আরাধনা। একচালার কাঠামোয় ডাকের সাজে প্রতিমা সাজানো হয়। দেবী মূর্তির দুপাশে বসানো থাকে জয়া ও বীজয়া নামে দুই পরির মূর্তি। মন্দিরচত্বর সাজানো হয় এক ভিন্ন আঙ্গিকে। একটি গোটা নারকেল, আম্র পল্লব ও একটি কাঁঠালি কলা একসঙ্গে নিয়ে বাঁধা থাকে মন্দির চত্বরের প্রতিটি থামে। প্রতিপদের দিন থেকে শুরু হয় পুজো। পঞ্জিকার নির্ঘন্ট মেনে পুজো করেন হুগলীর লোকনাথ এলাকা নিবসী কুল পুরোহিত ভোলানাথ চতুর্বেদি। পুজোয় অন্যন ফল যাই থাক কাজু, কিশমিশ, পেস্তা, আখরোট ও মেওয়া ফল চাই। নৈবেদ্য সাজানো হয় চিনির সন্দেশ, মুড়কি সহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে। পারিবারিক নিয়ম মেনে স্থলপদ্মে হয় দেবীর পুজো। একমাত্র সন্ধীপুজোয় লাগে ১০৮টি জল পদ্ম। সন্ধীপুজোর সময় দুটি মন্দিরের দেবী প্রতিমার সামনে ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা মহিলাকে দিয়ে ধুনো পোড়ানো হয়। পুজোর প্রতিটি দিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় হরেকরকম নিরামিষ ভোগ। মহাষ্টমীর দিন থেকে পুজোর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় মাখা সন্দেশ । পূর্বে ছাগ বলিদান প্রথা থাকলেও বেশকয়েক বছর হল বলিদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে এখন সন্দেশ নিবেদন করা হয়। নবমীর দিন একই সময়ে চকদিঘি ও মণিরামবাটির মন্দিরে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। জমিদার বাড়ির পুজোর জোগাড়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। সবকিছুই করেন জমিদার বংশের পুরুষরা।

এতকিছুর মধ্যেও সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাতায়াত থাকা এই সিংহরায় পরিবারের মহিলাদের এখনও পুজোয় পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়। এর কারণ প্রসঙ্গে জমিদার পরিবারের বর্তমান বংশধর অম্বরিশ সিংহরায়ের বক্তব্য, ‘অন্দর মহল থেকে পরিবারের মহিলারা মন্দিরে পুজো দিতে কিংবা ঠাকুর দেখতে আসার সময় তাঁদের পথের দু’পাশ আড়াল করার জন্য কাপড় দিয়ে ‘কানাত’ টাঙানো হয়।’ এর কারণ প্রসঙ্গে অম্বরিশবাবু বলেন, ‘পারিবারিক প্রথা মেনে পুজোর সময় আমাদের বাড়ির বউরা পর্দার পেছনে থাকেন। বংশ পরম্পরয়ায় এই ঐতিহ্য মেনে আসা হচ্ছে।’ জমিদার বাড়ির বউদের মুখ অন্য কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা তৈরি রাখা থাকে বলে পরিবার সদস্যদের কথায় জানা গিয়েছে। আগে পুজোয় বাগানবাটিতে হত যাত্রা পালা। এখন সেসব পাঠ উঠে গিয়েছে। প্রথা মেনে একাদশীতে কাঙ্গালি বিদায় পর্ব শেষে পুজোর সমাপ্তি ঘটে জমিদার বাড়িতে।

পুজোর কটাদিন বাগানবাটির ভিতরে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকে। তাই পুজোর দিনগুলিতে জমিদারি নিদর্শন পরিদর্শনে আসা মনুষজনের ভিড় উপচে পড়ে চকদিঘির এই বাগানবাটিতে। চকদিঘি বাগানবাটির পরিবেশ মুগ্ধ করেছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় মহাশয়কে। তার পরিচালিত ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমার প্রায় পুরোটারই শুটিং হয়ছিল এই বাগানবাটিতেই। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর চকদিঘি জমিদার বাড়ির পরিচিতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সুবিশাল এই বাগানবাটিতে আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয়।

Sushmita Ghosh
Sushmita Ghoshhttps://uttarbangasambad.com/
Sushmita Ghosh is working as Sub Editor Since 2018. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad Digital. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

coal smuggling case | কয়লা পাচার মামলা: সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ লালার, শর্তসাপেক্ষে পেলেন জামিন

0
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়, আসানসোল: আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালত থেকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন পেলেন কয়লা পাচার মামলার মূল অভিযুক্ত অনুপ মাজি ওরফে লালা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ...

স্বপ্নের নাম হতে পারে তেঁতুলিয়া করিডর

0
  অমিত দে উত্তরবঙ্গে প্রতিবার লোকসভা ভোটের মুখে যেসব নির্বাচনি ইস্যু ভেসে আসে তার অন্যতম হল তেঁতুলিয়া করিডর। জলপাইগুড়ি থেকে পশ্চিমে প্রায় সতেরো কিমি গেলেই...

Gourd Farming | ৭ ফুট লম্বা লাউ চাষ করে তাক লাগালেন তুফানগঞ্জের রূপম

0
তুফানগঞ্জ: লম্বায় ৭-৮ ফুট। উত্তরপ্রদেশে এই লাউয়ের চাষ হয়ে থাকে বলেই জানা যায়। এবার উত্তরবঙ্গের তুফানগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে এই লাউ চাষ করেছেন এক শিক্ষক। ইতিমধ্যে...

দেশের নির্বাচন আর একতরফা নয়

0
  উত্তম সেনগুপ্ত ভোটের মাঝপথে এসে দুটো ট্রেন্ড স্পষ্ট। প্রথমত, এটি আর একটা ঘোড়ার দৌড় নয়। দ্বিতীয়ত, ইন্ডিয়া জোট অপ্রত্যাশিত ভালো লড়াই চালাচ্ছে। তৃতীয়ত, চূড়ান্ত...

বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ গোসানিমারিতে

0
সিতাই: বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন বাসিন্দারা। মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে দিনহাটা ১ ব্লকের গোসানিমারিতে। প্রায় দু'ঘণ্টা চলে অবরোধ। স্থানীয় সূত্রে...

Most Popular